মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

| ২০ কার্তিক ১৪৩২

বীজের দখল নারীর হাত থেকে করপোরেটে, স্থায়িত্বশীল কৃষির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনা দরকার

প্রকাশ: ১৯:২৪, ৪ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৯:৩৪, ৪ নভেম্বর ২০২৫

বীজের দখল নারীর হাত থেকে করপোরেটে, স্থায়িত্বশীল কৃষির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনা দরকার

বীজ বংশবিস্তারের বাহক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বীজকে নানান নামে চেনে, যেমন বেচন/বেছন, বিচ্ছ, বীচি, দানা, গুটা, জার্ম, আঁটি ইত্যাদি। নাম যাই হোক, বীজ জীবনের বাহক, সৃষ্টির মূল উপাদান এবং সমৃদ্ধির প্রতীক। একটি ক্ষুদ্র বীজের মধ্যে নিহিত থাকে পৃথিবীর ইতিহাস, মানব সভ্যতার বিকাশ, প্রকৃতির বৈচিত্র্য এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। বীজ শুধু কৃষির উপকরণ নয়; এটি জীবন, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও ঐতিহ্যের ধারক। একটি বীজে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের অভিযোজন, মানুষের অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম, জ্ঞান এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের গল্প। অধুনা বীজ হলো, বৈশ্বিক বাণিজ্য পণ্য ও খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। বাজার অর্থনীতির যুগে বর্তমানে সারা বিশ্বে বীজের বাজার প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশে সে বাজার ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের।

নারী কৃষির সূচনাকারী, আদি যুগে তারা দক্ষতার সঙ্গে খাদ্য সংগ্রহ, বীজ বাছাই, সংরক্ষণ ও বিনিময়ের কাজ করতো। সহজাত জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নারীরা জানতেন, কোন বীজ ফলনশীল, কোনটি রোগ প্রতিরোধী বা কোনটি খরাপ্রবণ জমিতে টিকে থাকতে সক্ষম। এই প্রজ্ঞা থেকেই বিকশিত হয়েছিল প্রাচীন কৃষিবিজ্ঞান ও প্রজননবিদ্যার মূল ধাপ নির্বাচন। নারী এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জ্ঞান, সংস্কৃতি ও জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পৃথিবীর প্রথম প্রজননবিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

কৃষির বিকাশের সাথে সাথে পরিবারিক শ্রমবিভাগ গড়ে ওঠে। পুরুষের মাঠে কাজ, আর নারী সংগৃহীত ফসল ও বীজ প্রক্রিয়াকরণ- সংরক্ষণ করে আসছে। বীজ এমন এক কৃষি সম্পদ, যা এক মৌসুমে উৎপন্ন হয় ও পরের মৌসুমে ব্যবহার হয়, এ মধ্যবর্তী সময়ে নারীর প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ জ্ঞানই কৃষির ধারাবাহিকতার মূল চাবিকাঠি, আর প্রক্রিয়া ও সংরক্ষণ দক্ষতার আধুনিক নাম বীজ প্রযুক্তি। বীজ বিতরণ ও বিক্রয়ের কাজটিও নাটকীয় ঘটনা নয়। কৃষকের পরিবার নিজের প্রয়োজনে বীজ উৎপাদনের পাশাপাশি অতিরিক্ত বীজ প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সাথে বিনিময় বা বিক্রি করতেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল স্থানীয় বীজের অনানুষ্ঠানিক বিপণন, যা বিশ্বাস, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বরাতে জানা যায়, খাদ্য উৎপাদনের ইতিহাসে মানবজাতি প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ চাষ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪-৪.৫ হাজার প্রজাতি বীজ থেকে পুনরুৎপাদিত হয়। অন্যদিকে প্রায় ১.৫-২ হাজার প্রজাতি ছিল অঙ্গজভাবে পুনরুৎপাদনশীল, যেমন আলু, মিষ্টি আলু ও কলা ইত্যাদি। এই বিশাল বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার কাজটি করেছে পৃথিবীর কোটি কোটি ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বীজ সংরক্ষণ, বিনিময় ও পুনর্ব্যবহার করে আসছে।

কালের পরিক্রমায় বীজ কেবল কৃষির সঙ্গে নয়, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। বীজ মানে খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বনির্ভরতা। তাই বীজের নিয়ন্ত্রণ মানেই খাদ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও তাদের সহযোগীরা তাই বীজ সংগ্রহ ও ব্যবহারের স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে, আবার কখনও নানা ধরনের প্রকল্প তৈরি করে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বীজ সংগ্রহ শুরু করে। এদিকে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে কৃষিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। মেন্ডেলের বংশগতি সূত্রের পুনঃব্যবহার করে আধুনিক উদ্ভিদ প্রজননের ভিত্তি স্থাপন হয়, আর এর ফলেই কৃষিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, যার নাম সবুজ বিপ্লব।

সবুজ বিপ্লব ও শিল্পায়িত কৃষির উত্থানের পর থেকে কৃষিক্ষেত্রে ‘মানকরণ’ এবং ‘দক্ষতা’র ওপর জোর দেওয়া হয়। এর ফলে স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জাতগুলো ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়, জায়গা করে নেয় প্রজননগতভাবে একরূপ এবং উচ্চফলনশীল জাত। ছোট ও স্বাধীন বীজ উৎপাদক ও প্রজননকারীরা ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর একফসলি কৃষিতে আসক্ত বৃহৎ করপোরেট কোম্পানিগুলো তাদের স্থান দখল করে নেয়। এসব প্রতিষ্ঠান এমন সব বীজের প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিচ্ছে, যেগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ ও মুনাফার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

স্থানীয় বীজ বাজার দখলের আয়োজন হিসেবে, দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো সুদৃশ্য প্যাকেটে বীজ বিক্রির আয়োজন করে, অনুঘটক হিসেবে বাহারি বিজ্ঞাপন ও শিক্ষিত তরুণদের ব্যবহার করা হয়। এ আয়োজনকে পাকাপোক্ত করতে কৃষকের বীজকে বলা হতে লাগল, নিম্নমানের, কম উৎপাদনশীল, রোগবালাই বেশি ইত্যাদি  ইত্যাদি। প্রক্রিয়াটি শুধু বীজ কোম্পানিতে থেমে থাকেনি, শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এ বার্তা ঢুকে যায়, সর্বত্র কোম্পানির নতুন জাতের ওপর নির্ভরতা ও চাহিদা বাড়তে থাকে।

আরও একটি কৌশল এখানে চলতে থাকে যেমন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতার দুর্বলতা আছে, তাকে পুঁজি করে, দ্রুততম সময়ে চাহিদামাফিক জাতগুলোর বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্রপ্রধানরা জানেন পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকলে রাজনৈতিক বিপদ সমাগত। বিপদে বুদ্ধিনাশ, বন্ধুত্বের পথ সুদৃঢ় করতে উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শে নীতি-চর্চারও পরিবর্তন করা হয়, আবার সে নীতিগুলো বৈশ্বিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য করা হয়। এ সামঞ্জস্য করতে গিয়ে কিছু কুটিল ধারা সংযোজন করা হয়, তা কৃষকের স্বার্থের বাইরে গেলেও কোন কিছু করার থাকে না। দেখা গেছে যে, বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ ভূ-কুলগুলো এক সময় কৃষি পরিবারের হাতেই ছিল, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্টেন্টের নামে ভূ-কুলগুলো জার্মপ্লাজম বিনিময়ের নামে এ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রাকৃতিক সম্পদগুলো উচ্চফলনশীল জাত আকারে বাজারে আসছে। যেমন সবুজ বিপ্লবের নরিনজীন সমৃদ্ধ  ধান ও গম সংগ্রহ করা হয়েছে, যথাক্রমে তাইওয়ান ও জাপান থেকে, যা প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা ভূ-কুলসমূহে ছিল।

যাহোক বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় সবুজ বিপ্লবের উদ্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে, বীজের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে কৃষক-পরিবার তথা নারীর হাত থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাওয়া সম্পন্ন হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও পেটেন্ট আইনের মাধ্যমে বীজকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করে। এখন বীজকে বলা হয় ‘জিনগত সম্পদ’ বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি’; যা বিক্রয়যোগ্য, মালিকানাভুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত। বীজের ওপর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে কোম্পানিগুলো এখন ডিজিটাল ফার্মিং চালু করছে। বেশ কয়েক বছর যাবত বৈশ্বিকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, কোম্পানি বীজের ফলন কমে যাচ্ছে এবং ফলন হ্রাস ও রোগ প্রতিরোধের অজুহাতে তারা কৃষকের তথ্য সংগ্রহ করে, অর্থ পরিশোধ ক্ষমতা অনুযায়ী বীজের দাম নির্ধারণ করে। ২০১৯ সালে থেকে ‘ফলনভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ’ চালু করে, যেখানে ফলন কম হলে কোম্পানি অর্থ ফেরত দেবে, আর ফলন বেশি হলে কৃষককে অতিরিক্ত লাভের অংশ দিতে হয়। এতে কৃষকরা বাধ্য হয়ে কোম্পানির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয় ও তাদের নির্দেশনা মেনে চলে। ফলে কৃষক নিজের চাষাবাদের স্বাধীনতা হারিয়ে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু কোনো নিরাপত্তা বা সুবিধা দেওয়ার নজির দেখা যায় না।

একসময় কৃষক নিজেরা বীজ সংরক্ষণ, বিনিময় ও পুনঃব্যবহার করতেন—এটাই ছিল খাদ্য স্বাধীনতার মূল চক্র। কিন্তু এখন পেটেন্ট আইন অনুযায়ী, করপোরেট কোম্পানির তৈরি হাইব্রিড বা জিএমও বীজ সংরক্ষণ করা আইনত অপরাধ। ফলে কৃষক বাধ্য হচ্ছে প্রতি মৌসুমে নতুন বীজ কিনতে। ফলে বীজ আর জীবনের প্রতীক নয়, বরং লাভের পণ্য। নারীর হাতে লালিত বৈচিত্র্য বিলুপ্ত প্রায়, জীববৈচিত্র্য সংকুচিত, আর একক ফসলভিত্তিক কৃষি পরিবেশ ও পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট করতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। এফএও বরাতে জানা যায়, পৃথিবীর মানুষ এখন একক ফসলের আধিপত্যে। বিশ্বের মোট খাদ্য ক্যালরির অর্ধেকেরও বেশি আসে মাত্র তিন-চারটি ফসল থেকে—গম, ধান, ভুট্টা এবং সয়াবিন, যা খুবই উদ্বেগজনক।

বাংলার কৃষিতে বীজের বাণিজ্য প্রাচীনকাল থেকেই ছিল, তবে তা ছিল অনানুষ্ঠানিক, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে উপনিবেশিক কৃষিতে নীল, পাট ও বিদেশি আলুর প্রবর্তনের মাধ্যমে বীজ ধীরে ধীরে বাজারমুখী হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি বিকাশের অংশ হিসেবে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে সরকার বীজ উৎপাদন ও বিতরণে আনুষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলে। ১৯৯০-এর দশকে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। বিদেশি ও দেশীয় কোম্পানির অংশগ্রহণে বীজ বাণিজ্য ক্রমে আধুনিক হয়, কিন্তু কৃষকের নিজের সংরক্ষিত বীজের ওপর নির্ভরতা কমে যায়, কৃষকের বীজকে চিহ্নিত করা হয় অনানুষ্ঠানিক খাত।

বর্তমানে বাংলাদেশের বীজ খাত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বীজ আইন ২০১৮, উদ্ভিদ জাত সংরক্ষণ আইন ২০১৯ এবং জাতীয় কৃষি নীতি, ২০১৮ দ্বারা। এ সব নীতি-আইনপত্রে কৃষক বা নারীর অবস্থান প্রায় উপেক্ষিত, বাস্তবে দেখা যায়, এই আইনগুলোতে কৃষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অবদানের কোন স্বীকৃতি নাই, অধিকন্তু করপোরেট স্বার্থ রক্ষায় আইনগুলো বেশি কার্যকর।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে, দেশের বীজের চাহিদা ১৫-১.৫ লক্ষ টন, তন্মধ্যে আলু ও পেঁয়াজের বাল্ব বাদ দিলে, শুধু বীজ দরকার হয় ৪.৫-৫ লক্ষ টন। দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান (আউশ, আমন, বোরো), পাট, গম, ভুট্টা, সরিষা, সবজি ইত্যাদির বীজ আনুষ্ঠানিক খাত সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ১১-১২ ভাগ সরবরাহ করার সক্ষমতা আছে, বেসরকারি খাত করছে ১৪-১৫ ভাগ, যদিও তাদের বেশিরভাগ হাইব্রিড। উল্লেখ্য যে, বিএডিসি বা কোম্পানি তারা চুক্তিবদ্ধ কৃষকের কাছ থেকে বীজ উৎপাদন করে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মাধ্যমে প্রত্যায়িত করে, তা প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে। আবার এ কৃষকই যদি নিজের উৎপাদিত বীজ বিক্রি করতে চায়, নিদারুণভাবে সে বীজকে চিহ্নিত করা হয় মানহীন বীজ রূপে। অথচ দেশে এখনো শত শত কৃষক আছেন, যারা তাদের চর্চার মধ্য দিয়ে প্রজননবিদ, বীজপ্রযুক্তিবিদ কাজ করেছেন, স্থানীয়ভাবে তারা খুবই জনপ্রিয়, তাদের উৎপাদিত বীজের প্রতি স্থানীয় আস্থা সীমাহীন। এদের উদ্ভাবনা, জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগালে অনানুষ্ঠানিক খাতের বীজের মান ও সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব, সম্ভব বীজ-নিরাপত্তা গড়ে তোলা।

কোম্পানিগুলো দেশে উৎপাদন খুবই কম পরিমাণে করে, তারা দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করে বেশি, এগুলো মূলত হাইব্রিড ও আলুর বীজ। বিবিএস ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর আলু, সবজি, ধান, ভুট্টা ইত্যাদির প্রায় ৭০.০ মিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়, এত করেও ৩০-৩২ ভাগের বেশি জোগান দিতে পারে না। তা হলে বাকি বীজ ৬০ ভাগ বীজ কৃষকের উৎপাদিত ও সংরক্ষিত। নিজেদের বীজ বিক্রি করার স্বার্থে কৃষকের বীজকে বলা হচ্ছে মানহীন, আবার কৃষকের জ্ঞানকে নিজের জ্ঞান হিসেবে মেধাস্বত্ব ছিনতাই বা বায়োপাইরেসি হচ্ছে, এটা দেশে যেমন হচ্ছে তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও অনুসরণ করা হচ্ছে।

কোম্পানিগুলোর বীজ উৎপাদন ও কৌশল খুবই চমকপদ, যে ফসলে হাইব্রিড উৎপাদন করা যায় না, তা তারা বিপণন করে না। আবার দেশে হাইব্রিড বীজের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি। কোম্পানি আমদানি করতে খুব আগ্রহী, স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভালো জাত থাকা সত্ত্বেও সেগুলো উৎপাদন ও বিপণনে আগ্রহী নয়, যেমন ভুট্টা। শতভাগ ভুট্টার বীজ আমদানি করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আনুষ্ঠানিক খাতের অনেক অংশীজনদের বিদেশি বীজ আমদানির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, অর্থাৎ দেশীয় জাতের প্রতি আস্থা কম।

বীজ কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী ফাঁদ তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক বীজ চুক্তির আওতায় সংগৃহীত কৃষকের বীজ কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে, অথচ কৃষকের অধিকার রক্ষা হচ্ছে না। যেমন বিল গেটস-অর্থায়িত প্রকল্পে এসব বীজের জিন বিশ্লেষণ করে লাভজনক বৈশিষ্ট্য পেটেন্ট করছে। ফলে কৃষক নিজের বীজ ব্যবহার ও বিনিময়ের অধিকার হারিয়ে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে পড়ছে।

বীজ আমাদের যৌথ ঐতিহ্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম কৃষক ও নারী নিজেদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রম দিয়ে যে বৈচিত্র্যময় জেনেটিক ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছেন, তা রক্ষার দায় আমাদের সকলের। আধুনিক বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু এই বিজ্ঞানকে স্থানীয় জ্ঞান ও কৃষকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমন্বিত করতে হবে। ফলে একটি ন্যায়ভিত্তিক বীজ নীতি গঠন জরুরি, যেখানে: কৃষকের নিজস্ব বীজ সংরক্ষণ, বিনিময়ও বিক্রির অধিকার আইনি সুরক্ষা পাবে; নারীর ঐতিহাসিক অবদান স্বীকৃত হবে; করপোরেট নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্থানীয় জাত সংরক্ষণে সরকারি সহায়তা থাকবে; এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা হবে কৃষকের অংশীদারিত্বমূলক।

বীজ কেবল কৃষির নয়, এটি জীবনের ধারক। এটি সংস্কৃতির, জ্ঞানের, ও টেকসই ভবিষ্যতের প্রতীক। আজ করপোরেট দখল ও মুনাফার আবর্তের মধ্যে এই বীজকে মুক্ত রাখার প্রচেষ্টা শুধু কৃষকের নয়, মানবতারও। তাই প্রয়োজন এমন এক সমন্বিত ব্যবস্থাপনা যেখানে হাজার বছরের যৌথ জ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞান একসঙ্গে কাজ করবে, যেখানে কৃষকও সম্মানিত হবে, বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ রোধ হবে, মর্যাদাও রক্ষা পাবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট 
ইমেইল: nazim.68@gmail.com

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

ইসির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ; নিবন্ধন-প্রতীক পেল আরও ৩ রাজনৈতিক দল, এনসিপি পেল ‘শাপলা কলি’
‘প্রকাশ্যে ‘ফ্লার্ট’ করতে সক্ষম পুরুষই আমার পছন্দ’-মালাইকা অরোরা
নরফোক’র নতুন উদ্যেগ; প্রবীণদের জীবন বাঁচাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা
’ওয়ার অন টেরর’-এর স্থপতি ডিক চেনি মারা গেছেন
ছোটপর্দায় ফিরছেন কাঞ্চন মল্লিক!
নতুন রূপে সেলেসাও স্কোয়াড; নেইমার বাইরে, ফাবিনহোর প্রত্যাবর্তন
চলে গেলেন ৩ বার অস্কার পাওয়া কিংবদন্তি অভিনেত্রী ডায়ান ল্যাড
ভারতে ট্রেনের ধাক্কা, চূর্ণবিচূর্ণ বগি, নিহত ৪
বকেয়া না মেটালে ১১ নভেম্বর থেকে বিদ্যুৎ বন্ধের হুঁশিয়ারি আদানির
মুক্তি পাচ্ছেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ৩৭ বন্দি
বেলুচিস্তানে সেনা অভিযানে ভারত-সমর্থিত ৪ সন্ত্রাসী নিহত: পাকিস্তান
ঢাকায় পেঁয়াজের কেজি সেঞ্চুরি ছাড়িয়েছে
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত–শরীরচর্চা শিক্ষক পদ বাতিলে নারীপক্ষের তীব্র প্রতিবাদ
বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে গৌরীপুরে ট্রেন অবরোধ
সুপ্রিম কোর্টে ৪১ ডেপুটি ও ৬৭ সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দিল
সাগরে লঘুচাপ, দুই বন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত
কানাডায় শোতে বিতর্কে মাধুরী দীক্ষিত; দর্শকদের ক্ষোভ, টিকিট ফেরতের দাবি
নাসীরুদ্দীন তাসনিম নেতৃত্বে গঠিত এনসিপির কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি
১৮ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ট্রাম্পের বৈঠক
টিআইবি’র প্রতিবেদন : ৮৯১ প্রকল্পে ২ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম