দুটি অণুগল্প
নাসরিন আক্তার
প্রকাশ: ২২:৪০, ৪ নভেম্বর ২০২৫
নাসরিন আক্তার
সমুদ্র বিলাস
সমুদ্রের মুখোমুখি বসে থাকলে বুকের তলানি থেকে সব কথা কর্পূরের মতো বাতাসে মিশে যায়। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা লাগে। একটু আগেও একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, কিছুটা ঘূর্ণবৃষ্টি এখনো বাতাসে। নিয়ন সন্ধ্যা ছড়িয়ে পড়েছে বালুতটে। বিলাসছাতার নিচ থেকে উঠে আসে রাত্রি, বসে থাকতে ভালো লাগছে না, সমুদ্রের খুব কাছে যেতে ইচ্ছে করছে, খুব কাছে! পাশ ফিরে দেখে দু'ভাই এক ছাতার নিচে খুনসুটি করছে। রাশেদ অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আপন মনে সমুদ্র দেখছে।
রাত্রি রাশেদের বিপরীতে হেঁটে যায়। সবাই সমুদ্রের কাছে আসে আনন্দ করে হইহুল্লোড় করে খুনসুটি করে সুন্দর সময় কাটাতে। রাত্রির ভাগ্যে সেই সব সুন্দর মুহূর্ত কোনো দিনই আসেনি, ছেলেদের আবদারে এতটা দূর আসা, সেখানেও মন খারাপের মহড়া। এসব আর ভাবতে ভালো লাগে না রাত্রির। পোড়া ঘায়ের উপর মলম-পট্টি দিয়েই চলে যাচ্ছে জীবন।
শূন্যতাকে বরণ করে একাকিত্বের চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে সে। পেছন ফিরে দেখে ছেলেদের আনন্দ, হুটোপুটি। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে বাতাসে মিশে যায়। নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়তেই বাবার মুখটা ভেসে উঠে, বিয়ের সময় বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘পজিটিভ ভাবলে দেখবি আস্তে আস্তে সব পজিটিভ হয়ে গেছে।’ সত্যিই কি সব পজিটিভ হয়ে যায়!? দিনে দিনে সময় তো কম গড়াল না!
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে আসে রাত্রি, এখান থেকে রাশেদকে দেখা যাচ্ছে না, এর মাঝে মাগরিবের আজানও হয়ে গেছে, ও ভেবে নেয়, রাশেদ হয়তো নামাজে গেছে। সৎ ভালো মানুষ রাশেদ। ভালো মানুষ!, আর ভালো স্বামীর মধ্যে কতটা পার্থক্য!? কোথায় কমতি ছিল রাত্রির মাঝে তা রাত্রি খুঁজ পায়নি, রাশেদও কখনো ধরিয়ে দেয়নি। জীবনটা কম্প্রোমাইজ করেই চলে গেল। ‘কম্প্রোমাইজ’ শব্দটা মনে হতেই আবার বাবার মুখ ভেসে উঠে—বিয়ের পর বাবা দুজনকে পাশে বসিয়ে রাশেদের হাত ধরে বলেছিল, ‘রাত্রি এখনো অনেক ছোট, তুমি তো বড় একটু মানিয়ে চলো, এক্ষেত্রে তোমাকেই একটু বেশি কম্প্রোমাইজ করতে হবে।’ অথচ কম্প্রোমাইজ রাত্রিকেই করতে হলো, ‘কম্প্রোমাইজ’ শব্দটা জীবনের সবটুকু সময় বর্ণহীন করে দিলো। বিনিময়ে পেল অবহেলা, অবজ্ঞা। এই ওজনহীন জীবন নিজের কাছেই বড্ড বেশি ভারি, দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
এ দিকটা অনেকটাই নির্জন, সাধারণত ট্যুরিস্ট আসে না এ দিকটায়। সৈকতের উপরেই একটা কটেজ, কটেজটা সমুদ্রের দিকে মুখ করে পিলারের উপর বসান। সেখান থেকেই কয়েকজন ট্যুরিস্ট নেমে এসেছে সিঁড়ি বেয়ে। নিচের সৈকতটা অন্য পাশের সৈকতের মতো নয়। পুরোটা জায়গা জুড়েই ঝিরিঝিরি ঝরনা বইছে। পা রাখলেই তির তির করে পানি উঠে আসে। এরই ফাঁকফোকর গলে কখন সমুদ্রের এতটা কাছে চলে এসেছে রাত্রি নিজেও বুঝতে পারেনি। নির্জনতায় ছোট ছোট ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে, ঠিক যেন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। রাত্রিও এক পা এক পা এগোয়, আর ঢেউ ছুটে এসে পা ছুঁয়ে দূরে পালিয়ে যায়। একাকিত্বের শূন্য জায়গাটা পূরণ করে দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছে পরম মমতায় আলিঙ্গন করবে বলে। পিঠের উপরে খোলা চুল নরম বাতাসে মুক্তির স্বাদ নিচ্ছে, গায়ে জড়ানো ওড়নাটাও উড়ে যেতে চাইছে মুক্ত বাতাসে, আজ যেন ওর মনশরীরের সমস্ত বাঁধন খুলে যাচ্ছে। চারপাশটায় একটা মায়াময় পরিবেশ, সম্মোহিত রাত্রি একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যায়। এভাবে সমুদ্রের কতটা গভীরে চলে এসেছে নিজেও জানে না। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি সরে গিয়ে চিকন মশারির মতো রূপালী চাঁদ আলো ছড়ায় সৈকতে। একটা হিমশীতল বাতাস গায়ে লাগতেই চমকে সম্মোহন ভাঙে রাত্রির। কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে, কোথায় পালাচ্ছ রাত্রি? সমুদ্র শুধু নিতেই জানে, কিছুই ফিরিয়ে দেয় না। নদী তার সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে সাগরে ঝাঁপ দেয়, অথচ দেখ সাগর তার সবটুকু পানি গিলে লোনা করে ফেলে। তোমার এখনো অনেক ঋণ, তোমাকে ফিরতে হবে তোমার শিকড়ের কাছে। তোমার অস্তিত্বের কাছে।
রাত্রি পেছন ফিরে তাকায়, মোলায়েম আলোর ভেতর দিয়ে দূরে দুটি উৎসুক মুখ চোখে পড়ে। ছোট ছেলে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে মাকে খুঁজতে। তখনি লক্ষ্য করে ঠিক কতটা গভীরে চলে এসেছে ভাটার টানে। রাত্রি পেছন ফিরে গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে গর্জে উঠে সমুদ্র, বাঘিনীর মতো ফুঁসে উঠ। তর্জন-গর্জন করে বড় বড় ঢেউ ছুটে আসছে ওর দিকে। যেন চিৎকার করে বলছে, যেয় না প্রিয়, সফেদ ফেনায় শীতল বিছানা পেতে রেখেছি। বুকের উত্তাপ ঢেলে শরীর এলিয়ে দাও, ঢেউয়ের কূলে পরম শান্তিতে ঘুমাবে। ভয়ে রাত্রির শরীর কেঁপে উঠে। মনে হয় এই বুঝি আর ফিরতে পারবে না, পা দুটি চোরাবালিতে আটকে যাচ্ছে, দ্রুত পা চালায়। মনে মনে বলে, আমাকে ফিরতেই হবে আমার শিকড়ের কাছে আমার আত্মজের কাছে। এখনো আমার অনেক দায় বাকি।।
নারী
একদিন রেবেকা উপলব্ধি করলো, এই পৃথিবীতে সে কারোই কেউ নয়। কারো সন্তান নয়, কারো বোন নয়, কারো স্ত্রী নয়—এমনকি কারো প্রেয়সীও নয়। তার অস্তিত্ব বিলীন হতে হতে অবশেষে আবিস্কার করলো সে শুধু কোন একজনের সন্তানের মা। যার সন্তানকে সে এক ফোঁটা বীর্য হতে ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করেছে লালন করেছে। এই জনমে এই পৃথিবীতে এটুকুই কৃতিত্ব তার।
