বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

আহমেদ রাজু

বিভুদার মৃত্যু ও সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ 

প্রকাশ: ০১:১৬, ২৪ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ০১:১৭, ২৪ আগস্ট ২০২৫

বিভুদার মৃত্যু ও সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ 

আহমেদ রাজু

বিভুদা (বিভুরঞ্জন সরকার) এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে অনেক বার্তা দিয়ে গেলেন। তিনি প্রমাণ দিয়ে গেলেন, এখানে সৎ ও আদর্শবান মানুষের স্থান নেই, মূল্য নেই। দুর্নীতিবাজ, অসৎ ও লুটেরাদের লালন করে এই সমাজ।

বিভুদা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত একজন আপাদমস্তক সৎ সাংবাদিক। তিনি কখনো টাকার পেছনে ছোটেননি। কারও দালালি কিংবা দলবাজি করেননি। এ কারণেই বিখ্যাত সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনো কোনো বড় পত্রিকার সম্পাদক হতে পারেননি। কারণ রাজনৈতিক ট্যাগ না থাকলে এখন পত্রিকার সম্পাদক হওয়া যায় না। 

কেউ কেউ বলবেন, তিনি তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেছেন। তাহলে বিগত সরকারের আমলে তার ভাগ্যের উন্নতি হলো না কেন? কারণ তিনি  নেতাদের পদলেহন করেননি। যদি করতেন, অবশ্যই তিনি কোনো না কোনো সুবিধা নিতে পারতেন। 

কাউকে নিয়ে বই লেখা তার ব্যক্তিস্বাধীনতা। এর সাথে পেশাগত জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। সেই স্বাধীনতা থেকেই কেউ কেউ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়েও বই লিখেছেন। এটাও তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা। একে দালালি হিসেবে গণ্য করা বোকামি ও মূর্খতা।   

চারদিকে এখন রাজনৈতিক দলের কর্মীসাংবাদিকদের জয়জয়কার। তাদের ভিড়ে হারিয়ে গেছেন অনেক মেধাবী সাংবাদিক। অনেকে দেশান্তরি হয়েছেন। আর তাদের পদদলিত হয়ে জীবন দিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। 

বিভুদার সাথে আমার অনেক স্মৃতি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি যখন সাপ্তাহিক চলতিপত্র সম্পাদনা শুরু করেন, তখন তিনি তার পত্রিকায় একঝাঁক তরুণের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমের শীর্ষপদে কর্মরত। 

আমি তখন দৈনিক আল-আমীন-এ কাজ করতাম। লিখতাম চলতিপত্রে। সেখান থেকেই সখ্য হয় বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক আহসান কবির এবং এই সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের সাথে। বিশেষ করে এই দুজনের লেখা আমাকে খুব মুগ্ধ করতো। এখনো তাদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক বিদ্যমান।   

সেই সময় বিভুদাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। প্রত্যেকটি রিপোর্ট এবং লেখা তিনি খুঁটেখুঁটে পড়তেন। যতোক্ষণ না সন্তুষ্ট হতেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত তিনি একই লেখা বারবার সংশোধন করতেন। মনে পড়ে, এক বিশেষ সংখ্যায় আমার একটি লেখা তিনি আমাকে দিয়ে অনেকবার লিখিয়েছিলেন। যতোবারই লিখি, তিনি সন্তুষ্ট হন না। শেষে পুরো লেখাটা তিনি নিজের মতো করে সম্পাদনা করেন।

সাংবাদিকতা এখন দলবাজি ও সিন্ডিকেট নির্ভর। সিন্ডিকেট রক্ষা ও দলীয়কর্মী না হলে যে যতো বড়ই সাংবাদিক হোক না কেন, চাকরি মিলবে না। কিন্তু বিভুদা কোনো সিন্ডিকেট মেনটেন করতেন না। তাই তিনি সাংবাদিকতায় সুবিধা করতে না পেরে শেষে স্টেপ টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট নামে এক এনজিওতে চাকরি নিয়েছিলেন। অফিস ছিলো লালমাটিয়ায়। সেই অফিসে আমি অনেকবার তার সাথে দেখা করেছি। তিনি তার হতাশার কথা বলতেন। কীভাবে সাংবাদিকতা থেকে ছিটকে পড়লেন, সেসব কথা বলতেন। একসময় যাদের সাংবাদিক হতে সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের অনেকেই গণমাধ্যমের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। অথচ তাদের কাছে চাকরি চাইলেও কেউ তা দেননি। 

সাংবাদিকতা থেকে দূরে থাকার দীর্ঘদিন পর নাঈমুল ইসলাম খান তাকে আবার এই পেশায় ফিরিয়ে আনেন। চার বছর আগে তিনি যোগ দেন আজকের পত্রিকায়। সেখানেও তিনি পেশাগতভাবে নিগৃহীত হন। 

বিভুদার খোলা চিঠিতে সাংবাদিকতার ভেতরের অনেক নগ্নচিত্র বেরিয়ে এসেছে। গ্রাম থেকে ধরে এনে তিনি যাদের সাংবাদিক বানিয়েছিলেন, সেই তারাই কীভাবে অল্পসময়ে বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেলেন, তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। তারা গণমাধ্যমের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হলেও কখনো তারা বিভুদার খোঁজ নেননি। নিদারুণ অর্থকষ্টে থাকলেও তারা কখনো পাশে এসে দাঁড়াননি। এটাই হচ্ছে, আজকের সাংবাদিকতার নোংরা, কদর্য ও কুৎসিত অবয়ব। কিন্তু আগে এমনটি ছিলো না।

যখন সাংবাদিকতায় দলবাজ ও দল দাসদের অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে, তখন থেকেই বদলে যেতে থাকে সাংবাদিকতা। এক একটি সরকার বদলের পর সাংবাদিকতা নতুন করে আকৃতি নেয়। চর দখলের মতো কুক্ষিগত হয় গণমাধ্যম। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীসাংবাদিকরা ভিন্নমতের সাংবাদিকদের এ পেশা থেকে উৎখাত করেন। আবার সরকার বদল হলে নতুন সরকারের দলীয় কর্মীসাংবাদিকরা পতিত সরকারের সমর্থক সাংবাদিকদের এই পেশা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেন। পৃথিবীতে কোনো পেশাতেই এমনটি নেই।

সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশায় এমনটি হলো কেন? রাজনৈতিক মতভেদের কারণে নব্বই দশকের শুরুতে সাংবাদিক ইউনিয়ন দ্বিখন্ডিত হলো। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হলো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি। এখনকার সাংবাদিকদের বেশিরভাগই একেকজন রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং নেতা। কারণ রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক না হলে কেউ চাকরি পান না। এই রাজনৈতিক বিভক্তিই সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আর এই বিভক্তির শিকার বিভুদার মতো সৎ ও গুণী সাংবাদিকরা। 

সরকার যায়, সরকার আসে। কিন্তু সাংবাদিকতার কোনো পরিবর্তন হয় না। পাঁচ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এই পেশার অনেকে ভেবেছিলেন, গণমাধ্যমেও একটা আমূল পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই আশা গুড়ে বালি। বিভুদা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, এই পেশার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আছে শুধু হতাশা ও অন্ধকার। পরিবর্তন, সে সুদূর পরাহত।

লেখক: সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: