ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত
যখন টাকা মরে যায়
হানি কারমুত
প্রকাশ: ১৫:৫৮, ২৪ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১৬:০০, ২৪ আগস্ট ২০২৫

গাজার রাস্তায় এক নারী এক কেজি ময়দা কিনতে যান।
তিনি মানিব্যাগ খুললেন। ভেতরে কী আছে?
একটি পুরনো, বিবর্ণ ১০-শেকেল নোট—যা টেপ দিয়ে কোনোভাবে জোড়া দেওয়া।
কেউ নিতে চায় না। এগুলো এখন আবর্জনা।
একসময় ১০ শেকেল (প্রায় ৩ ডলার) ছিল গাজার সবচেয়ে প্রচলিত নোট।
আজ তা আর ব্যবহারযোগ্য নয়। সরকারি ভাবে বাতিল হয়নি, কিন্তু বাস্তবে অচল হয়ে গেছে। বিক্রেতারা নেয় না, ক্রেতারা ব্যবহার করতে পারে না।
কোনো নতুন টাকা ঢুকছে না। কোনো সরবরাহ নেই।
ব্যাংকনোটের মৃত্যু
১০ শেকেলের মতো ধীরে ধীরে অন্য নোটও একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে, বিশেষ করে ছোট নোটগুলো।
যদি ১০০ শেকেলের নোট দিয়ে ৮০ শেকেলের জিনিস কেনেন, ফেরত ২০ শেকেল বিক্রেতা দিতে পারবে না—কারণ ফেরত দেওয়ার মতো ব্যবহারযোগ্য নোটই নেই।
অনেক নোট ছেঁড়া বা টেপ লাগানো। এখন এমনকি ভাঙা টাকা সারাই করার দোকানও বসেছে, যাতে কোনোভাবে লেনদেন চালানো যায়।
বেতনহীন জীবন
এটাই একমাত্র সমস্যা নয়। সরকারি কর্মচারীরা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না।
এনজিও কর্মীরাও বেতন পাচ্ছেন না।
বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজন রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না।
পুরো অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। কবে সমাধান হবে—কোনো খবর নেই।
টাকার কালোবাজার
যদি বাইরের কারও কাছ থেকে টাকা পান—ধরুন রামাল্লার কোনো আত্মীয় বা মিশরে থাকা ভাইবোন—তাহলে ভয়ংকর মূল্য দিতে হয়।
আপনার কাছে যদি ১,০০০ শেকেল ($৩০০) পাঠানো হয়, এজেন্ট আপনাকে হাতে ধরিয়ে দেবে মাত্র ৫০০। অর্থাৎ গাজায় নগদ তোলার কমিশন এখন ৫০ শতাংশ।
কোনো ব্যাংক খোলা নেই। সব শাখা ফাঁকা। কোনো এটিএম কাজ করছে না।
শুধু দালাল আর কালোবাজারীরা নগদ জোগাড় করে। তারা বিশাল ভাগ কেটে নেয়। মানুষ বাধ্য হয়ে সেটাই ব্যবহার করে।
টাকা নেই, কার্ড অকেজো
আপনার কাছে ব্যাংক কার্ড আছে? ভালো কথা। ব্যবহার করতে পারবেন?
না।
কারণ নেই বিদ্যুৎ, নেই ইন্টারনেট, নেই পস মেশিন। দোকানদার কার্ড দেখে মাথা নাড়ে।
মানুষ তাদের অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের স্ক্রিনশট প্রিন্ট করে ঘুরে বেড়ায়, হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে। কিন্তু কেউ করে না।
বাটার অর্থনীতি
কিছু দোকানি “ডিজিটাল ওয়ালেট” নেয়, তবে সেটাও খুব সীমিত।
গাজায় এখন টাকা মানে—হাতে পাওয়া টাকা।
না হলে কোনো মূল্য নেই।
তাই মানুষ জিনিস দিয়ে জিনিস বদলাচ্ছে।
বাজারে একজনের হাতে এক ব্যাগ চিনি, অন্যজনের হাতে তেলের বোতল। একে অপরকে দেখে মাথা নেড়ে বদলে চলে গেল।
এভাবেই বাজার চলছে।
এক কেজি ডাল দিয়ে দুই কেজি ময়দা।
এক বোতল ব্লিচ দিয়ে কিছু চাল।
একটি শিশুর জ্যাকেট দিয়ে কয়েকটা পেঁয়াজ।
মূল্য স্থায়ী নয়। আজ কিছু দামি, কাল কেউ নিতেই চায় না।
সব কিছু আলোচনাভিত্তিক।
“আমি কোট দিয়ে এক ব্যাগ ডায়াপার নিয়েছি,” বললেন আমার চাচা ওয়ালিদ।
“আমাকে ভিখারির মতো দেখা হচ্ছিল। মনে হলো জীবনের একটা অংশ দিয়ে দিলাম।”
প্রতিদিনই জরুরি অবস্থা
আমার পাশের তাঁবুর প্রতিবেশী লিনা বললেন, “আমি আমার সোনার ব্রেসলেট বিক্রি করেছি। ওটা জরুরি অবস্থার জন্য রেখেছিলাম। কিন্তু এখন প্রতিদিনই জরুরি অবস্থা।”
গাজার অর্থনীতি কোনো ভুল নীতি বা অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার কারণে ভাঙেনি।
এটা ভাঙা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে।
অবরোধ শুধু পণ্যের প্রবাহ বন্ধ করেনি—বন্ধ করেছে মুদ্রার প্রবাহও।
ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। তারল্যকে অস্ত্র বানিয়েছে।
বেঁচে থাকার লড়াই
রুটি, পানি, ওষুধ—কিছুই কিনতে পারছেন না।
তাহলে কীভাবে বাঁচবেন?
এইভাবে চলতে থাকলে গাজা হবে আধুনিক যুগের প্রথম অঞ্চল, যেখানে অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বিনিময় প্রথায় (barter) ফিরে যাবে।
কোনো বেতন নেই, কোনো আনুষ্ঠানিক বাজার নেই, শুধু বিনিময় আর চুক্তি।
কিন্তু সেগুলোও শেষ হয়ে যাবে—যখন আর কিছু বিনিময়ের মতো অবশিষ্ট থাকবে না।
তখন গাজা শুধু অবরুদ্ধ অঞ্চল থাকবে না।
এটা হবে এমন এক জায়গা যেখানে অর্থ, বাজার, ন্যায্যতার ধারণাই চিরতরে মরে যাবে।
হানি কারমুত
গাজার সাংবাদিক ও গল্পকার
মূল লেখা : আল জাজিরা
অনুবাদ : সমাজকাল ডেস্ক