সোমদীপ সেন
ইসরায়েলের জন্য ১০ দফা কর্মপরিকল্পনা
প্রকাশ: ১৬:০৪, ৭ অক্টোবর ২০২৫

গত শুক্রবার হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত “গাজা শান্তি পরিকল্পনার ২০ দফা”–এর জবাব পাঠিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফিলিস্তিনি সংগঠনটি সম্মতি দিয়েছে গাজার প্রশাসন একটি টেকনোক্র্যাটদের দলকে হস্তান্তর করতে এবং সমস্ত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিতে, বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি চেয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই জবাবকে স্বাগত জানিয়ে ইসরায়েলকে “অবিলম্বে বোমা হামলা বন্ধ করার” নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু হামাসের জবাব পাঠানোর পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় অন্তত ৯৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা হয়তো ফিলিস্তিনিদের জন্য সাময়িক স্বস্তি আনবে, কিন্তু এতে স্থায়ী শান্তি আসবে না। কারণ শান্তির জন্য শুধুমাত্র হামাস বা গাজার ওপর নয়, ইসরায়েলের ওপরও শর্ত আরোপ করতে হবে—যে রাষ্ট্রটি দীর্ঘদিন ধরে গণহত্যার নীতি অনুসরণ করছে।
তাই, ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে নীচে একটি ১০ দফা কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হলো—
১. ইসরায়েলি রাজনীতি ও জনপরিসরকে ‘অতি–উগ্রতা’ থেকে মুক্ত করতে হবে।
গত ২৪ মাসে ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণহত্যার উল্লাসে মেতে উঠেছে—গাজার ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টাকে তারা প্রকাশ্যে উদ্যাপন করেছে এবং সম্পূর্ণ দায়মুক্তি ভোগ করছে। এ সময় ইসরায়েলের সাধারণ জনগণের বড় অংশও এই উগ্র মানসিকতায় শরিক হয়েছে। তাই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থায় সহনশীলতা, শান্তি ও সহাবস্থানের মূল্যবোধ শেখানোর রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি নিতে হবে।
২. ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে।
ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইচ্ছাকৃত হামলা, কিংবা সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ধ্বংসযজ্ঞের ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে গর্বের সঙ্গে প্রকাশ করা—এসব ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গভীরে প্রোথিত মানবতাবিরোধী সংস্কৃতির পরিচায়ক। তাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানবিক যুদ্ধনীতির আলোকে নতুন সামরিক আচরণবিধি (code of conduct) প্রণয়ন ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. ইসরায়েলি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রমাণ সংগ্রহ করছে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা। এই প্রমাণের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার শুরু করা উচিত।
৪. গাজাকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করতে হবে।
২০০৭ সাল থেকে স্থল, জল ও আকাশপথে যে অবরোধ চলছে, তা তুলে নিতে হবে। মানুষ ও পণ্যের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বা সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
এই বাহিনী নিশ্চিত করবে যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বা কোনো উগ্র ইসরায়েলি গোষ্ঠী—দু’পক্ষের কেউই গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে।
৬. পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন সম্পূর্ণ বন্ধ ও দণ্ডনীয় করতে হবে।
২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। তাই নতুন বসতি স্থাপন, তহবিল সংগ্রহ, প্রচারণা বা লবিং—এসব কার্যক্রম আইনি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
৭. পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমকে সামরিকীকরণমুক্ত ও দখলমুক্ত করতে হবে।
এতে ইসরায়েলকে চেকপোস্ট, সামরিক টাওয়ার, দেয়াল ও অন্যান্য অবকাঠামো অপসারণ করতে হবে—যেগুলো ফিলিস্তিনের ভূমিকে ছিন্নভিন্ন করেছে এবং তাদের স্বদেশে ফেরার অধিকারে বাধা দিচ্ছে।
৮. প্রশাসনিক আটক নীতি (Administrative Detention) বাতিল করতে হবে।
মার্কিন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইসরায়েলকে ২৫০ জন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ও ১,৭০০ জন বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু এখনও বিচার ছাড়াই হাজারো ফিলিস্তিনি বন্দি রয়েছে। এ নীতি দ্রুত বাতিল করতে হবে এবং সমস্ত বন্দির মুক্তির একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে।
৯. ফিলিস্তিনিদের ‘স্বদেশে ফেরার অধিকার’ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।
এটি ঘটতে হবে সরাসরি ফিলিস্তিনের জনগণ, প্রবাসী ফিলিস্তিনিরা, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও শরণার্থী বিষয়ক নাগরিক সংগঠনের অংশগ্রহণে। ফিরে আসার অধিকার শুধু নীতিগত নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।
১০. ইসরায়েলের বৈশ্বিক জনসংযোগ ও প্রচারণা তহবিলের তদন্ত করতে হবে।
বিগত বছরগুলোতে ইসরায়েল তার নীতিকে সমর্থন জোগাতে বিশ্বব্যাপী জনসংযোগে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। ২০২৪ সালে এই খাতে প্রায় ১৫ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়—যার মধ্যে রয়েছে প্রো–ইসরায়েল প্রচারণা, বিদেশি রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সফর, লবিং ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এই অর্থ ব্যবহারের ফলে বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে ফিলিস্তিন–সংহতি আন্দোলন দমন সহজ হয়েছে। তাই একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করে দেখতে হবে এই প্রচারণা অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করছে কি না।
অবশ্য, ইসরায়েলি সরকার স্বেচ্ছায় এই ১০ দফা বাস্তবায়ন করবে—এমন আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—বিশ্ব জনমত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। ইসরায়েলের সরকারি প্রচারণা আর আগের মতো প্রভাবশালী নেই। বিশ্বের মানুষ বুঝতে পারছে, ফিলিস্তিন প্রশ্ন কেবল ফিলিস্তিনিদের নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক রাজনীতির এক কেন্দ্রীয় ইস্যু।
সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে তখনই, যখন আমরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ওপর ন্যায়সংগত দায়ভার আরোপ করব এবং বৃহত্তর ন্যায়ের প্রশ্নে দৃঢ় থাকব।
মূল মতামত : আলজাজিরা
অনুবাদ : সমাজকাল ডেস্ক
লেখক : সোমদীপ সেন
(অ্যাসিয়ান স্টাডিজ, প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ আফ্রিকা)