সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান
দেশে রবিবার থেকে টাইফয়েড টিকা, এই টিকা নিরাপদ-পরীক্ষিত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭:২২, ৯ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৭:২২, ৯ অক্টোবর ২০২৫

আগামী রবিবার (১২ অক্টোবর) থেকে মাসব্যাপি শিশু-কিশোরদের বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকা দেবে সরকার। ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় ৫ কোটি শিশু-কিশোর এক ডোজ করে এই টিকা পাবে।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১১টায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ‘টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন-২০২৫’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান।
এই টিকাকে কার্যকর ও নিরাপদ উল্লেখ করে নির্দ্বিধায় সবাইকে টিকা নেওয়া আহ্বান জানান বিশেষ সহকারী। তিনি বলেন, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যাচাই করা (প্রি-কোয়ালিফাইড) টিকা। বাংলাদেশ সরকার কখনোই নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচিতে কোনো টিকা অন্তর্ভুক্ত করে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এ টিকার নিরাপত্তা ও মান নিশ্চিত করা হয়েছে।
টাইফয়েডে বছরে মৃত্যু ৮ হাজার:
বিশেষ সহকারী জানান, দেশে টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য মারাত্মক সংক্রামক রোগগুলোর মাঝে টাইফয়েড জ্বর অন্যতম।
গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ স্টাডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে ৭০ লাখের বেশি মানুষ টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ৯৩ হাজার মানুষ। এই মৃত্যুর বেশির ভাগ দক্ষিণ এশিয়ায়।
বাংলাদেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি শিশুরাই টাইফয়েড জ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার মানুষ টাইফয়েড জ্বরে মারা যায়। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশ বা ৬ হাজার ১৫ বছরের কম বয়সি শিশু।
এই টিকা টাইফয়েড থেকে রক্ষা করে
টাইফয়েড টিকায় শিশু-কিশোরদের টাইফয়েড সংক্রমণজনিত জ্বর ও মৃত্যুহার অনেক কবে এবং এটি টাইফয়েড প্রতিরোধযোগ্য বলে জানান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, এই টিকায় এন্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ কমে আসবে।
বিশেষ সহকারী জানান, সালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। বিশ্বে টাইফয়েড প্রাদুর্ভাব অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান। মূলত দূষিত পানি, খাবারের মাধ্যমে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছনতার অভাবে টাইফয়েড ছড়িয়ে থাকে।
বিশেষ সহকারী আরো জানান, বর্তমানে বিশ্বে ঝুঁকিপুর্ণ অবস্থায় রয়েছে ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড। টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসায় প্রচলিত যেসব এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমান টাইফয়েড নিরাময়ে কাজ করছে না। ফলে ভয়াবহ ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে।
যেভাবে দেওয়া হবে টিকা:
আগামী ১২ অক্টোবর থেকে মাসব্যাপী সারাদেশে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু হবে। এসময় ৫ কোটি শিশুকে অত্যন্ত কার্যকর ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হবে।
দেশের প্রাক-প্রাথমিক ( প্লে, নার্সারি, কিন্ডারগারটেন) থেকে ৯ম শ্রেণি/সমমান ( মাদ্রাসা, ইংরেজি মিডিয়াম) পর্যন্ত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভুত ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশু-কিশোরদের কমিউনিটি পর্যায়ে ইপিআই টিকাদান কেন্দ্রে বিনামূল্যে ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা দেওয়া হবে।
এই টিকা নিরাপদ ও পরিক্ষিত:
বিশেষ সহকারী জানান, টাইফয়েডের এই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা পরিক্ষিত ও নিরাপদ । এই টিকায় একই সাথে প্রোটিন ও শর্করা থাকায় দুটি উপাদানই শরীরে টাইফয়েড রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরি করে। তাই অন্যান্য টাইফয়েড টিকার তুলনায় এটি উন্নততর এবং অধিক কার্যকর। বাংলাদেশে এই টিকা কোন প্রকার ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে না। সামান্যতম সন্দেহ বা ঝুঁকি থাকলে সেই টিকা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত সরকার কখনই নেয় না। টাইফয়েড টিকাসহ ইপিআইয়ের সব টিকা সঠিক তাপমাত্রায় পরিবহন এবং সংরক্ষণ করা হয়। তাই সরকারের এই টিকা নিয়ে কোন প্রকার সংশয় বা বিভ্রান্ত হওয়ার কোন অবকাশ নেই।
বিশেষ সহকারী আরো জানান, পাকিস্তান ২০১৯ সাল ও নেপাল ২০২২ সাল থেকে শিশুদের এই টিকা দিচ্ছে। তাদের দেশে শিশুদের কোন বিশেষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ভারতের মুম্বাই সিটি কর্পোরেশনেও এই টিকা দেওয়া হয়েছে।
আতংকিত হওয়ার কিছু নেই:
এই টিকা নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, টাইফয়েড টিকা নেওয়ার পর অন্যান্য টিকার মতই সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন- টিকাদানের স্থান লালচে হওয়া, সামান্য ব্যথা, মৃদু জ্বর, ক্লান্তি ভাব হতে পারে, যা এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে টিকা গ্রহণের সময় দেখা যায় একই সাথে অনেক কিশোর কিশোরী অসুস্থতা বোধ করছে বা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। এতে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘ম্যাস সাইকোজেনিক ইলনেস’ বলে, যা টিকা নেওয়ার আগে ও পরে মানসিক ভীতিজনিত কারনে হয়ে থাকে। এর সাথে টিকাজনিত অসুস্থতার কোন সম্পর্ক নেই।
এমনকি এই টিকায় শরীয়ত নিষিদ্ধ কোন উপকরণ নেই। টাইফয়েড টিকা সৌদি হালাল সেন্টার কর্তৃক হালাল সনদপ্রাপ্ত।
টিকা নিতে যেভাবে নিবন্ধন করতে হবে:
সংবাদ সম্মেলনে টিকা নিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়। বলা হয়, Vaxepi.gov.bd ওয়েবসাইটে ১৭ সংখ্যার জন্মনিবন্ধন তথ্য দিয়ে খুব সহজেই টাইফয়েড টিকার জন্য নিবন্ধন করা যাবে। এ জন্য VaxEPI প্লাটফর্মে শিশুদের নিবন্ধন চলছে। ৮ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ শিশু টাইফয়েড টিকার জন্য নিবন্ধন করেছে।
যাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই তাদের তালিকা প্রস্তুত করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।
এছাড়াও এই ক্যাম্পেইনে ডিজিটাল অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের মাইক্রোপ্লান এবং রিপোরটিং সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার পরামর্শ:
বিশেষ সহকারী বলেন, টাইফয়েড টিকা খুবই নিরাপদ। এরপরেও টিকাদানের পর বিরুপ ঘটনা মোকাবেলার জন্য জেলা/উপজেলা এবং সিটি কর্পোরেশান পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সকল কমিটির প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে এবং সকল পর্যায়ে AEFI কিট box ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে।
বিশেষ সহকারী বলেন, কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এই টিকা নিয়ে আস্থাহীনতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচারের প্রবনতা লক্ষ করা গেছে। এর কারণ হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেকোনো নতুন টিকা দেওয়ার সময় ওই টিকা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত ধারনা থাকে না। ফলে টিকা সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করে থাকে, যা টিকা প্রদান কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে পারে। তাই টাইফয়েড টিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ক্যাম্পেইন সংগঠন সহায়িকা, সচরাচর জিজ্ঞাসা লিফলেটে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
তিনি টিকা সম্পর্কে মনগড়া কোন মন্তব্য বা মতামত না করে বিস্তারিত জানার জন্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা/সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনের অথবা কোন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানান।
বিশেষ সহকারী বলেন, যদি কোন অপপ্রচার হয়ে থাকে, তাহলে তা সমাধানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কিম্বা ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সহায়তা নিতে পারেন। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে মনে রাখতে হবে টিকার কারনেই বাংলাদেশ পোলিও মুক্ত হয়েছে, হেপাটাইটিস -বি, হাম রুবেলা নিয়ন্ত্রনে এসেছে, মা ও শিশুর ধনুষ্টংকার দূরীকরণ হয়েছে, ভবিষ্যতে টিকা দিয়েই টাইফয়েড রোগ নিয়ন্ত্রন এমনকি নির্মূল করা সম্ভব হবে।
সফল করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ:
এই টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় , শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কওমি মাদ্রাসা, স্কাউট ও গার্লস গাইডের সাথে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর , এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও এর সহযোগিতায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু, বেদে পল্লী, চা বাগান, এতিমখানা, শিশু/ কিশোর/কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র, পথশিশু, যৌনপল্লীতে থাকা শিশুদের তালিকা করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় টাইফয়েড টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এই টিকাদান নিশ্চিত করতে মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশান এপ্রোচ অনুসরন করা হয়েছে, যাতে সকল শ্রেনীপেশার মানুষ, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের এই টিকা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারে। সে লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ উপকরণ, যেমন- পোস্টার, লিফলেট, ফ্যাক্টশিট, FAQs, ইনফোগ্রাফ, ব্যানার, জিংগেল, টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচারের জন্য অডিওভিজ্যুল উপকরণ। এছাড়াও জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে এডভোকেসি কর্মশালার আয়োজন চলমান রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- শিক্ষক, ইয়ুথ ভলান্টিয়ার, ধর্মীয়নেতৃবৃন্দ, সংবাদকর্মী এবং স্বাউট ও গার্লস গাইড এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার মাঠপর্যায়ের কর্মীগণ।
৪৬ বছর ধরে চলছে টিকাদান কর্মসূচি
সংবাদ সম্মেলনে বিশেষ সহকারী জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৯৭৯ সাল থেকে, অর্থাৎ প্রায় ৪৬ বছর ধরে সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) চলছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য বিভিন্ন সংক্রামক রোগজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশব্যাপী শিশু, কিশোরী এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নারীদের বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হচ্ছে।
ইপিআই বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবায় একটি অন্যতম সফল কার্যক্রম হিসেবে দেশ ও বিদেশে বহুল প্রশংসিত। ইপিআই টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৪২ লাখ শিশুকে বিভিন্ন প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।