২৩ আগস্ট ১৯২৩ – ২০ জুন ২০০৭
নাজিক আল-মালাইকা : আধুনিক আরবি কবিতার অগ্রদূত
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫:৩৭, ২৩ আগস্ট ২০২৫

ইরাকের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে নাজিক আল-মালাইকার নাম এক আলোকিত অধ্যায়। তিনি শুধু একজন নারী কবিই নন, বরং আরবি সাহিত্যভুবনে মুক্ত শ্লোকের পথপ্রদর্শক। ২০শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন আরবি কবিতা কঠোর ছন্দে আবদ্ধ, তখন নাজিক সেই কাঠামো ভেঙে আধুনিকতার নতুন দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
জীবন ও শিক্ষাজীবন
নাজিক আল-মালাইকা জন্মেছিলেন ১৯২৩ সালের ২৩ আগস্ট, বাগদাদে। শৈশব থেকেই তিনি সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি তিনি আরবি কবিতা, পাশ্চাত্য সাহিত্য এবং দর্শনের ওপর গভীর মনোনিবেশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তিনি নিজের সাহিত্যবোধকে আরও সমৃদ্ধ করেন।
শিক্ষকতা ও কর্মজীবন
নাজিক দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে মসুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু শিক্ষকই নন, ছিলেন এক প্রেরণাদাত্রী। তাঁর বক্তৃতা ও লেখনী তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্ত চিন্তার পথে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশত্যাগ
১৯৭০ সালে ইরাকে আরব সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির ক্ষমতা দখলের পর রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি স্বামী আবদেল হাদি মাহবুবা ও পরিবারসহ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। প্রথমে কুয়েতে, পরে সাদ্দাম হোসেনের আগ্রাসনের পর কায়রোতে স্থায়ী হন। জীবনের শেষ পর্বে তিনি পারকিনসনসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগলেও সাহিত্যচর্চা ছাড়েননি।
সাহিত্যকর্ম
নাজিক আল-মালাইকা আরবি কবিতায় নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর রচনাগুলোতে সামাজিক অসাম্য, মানবিক বেদনা, নারীর অবস্থান ও যুদ্ধ–দুর্দশার প্রতিফলন রয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থসমূহ:
- “দ্য নাইটস লাভার” (عاشقة الليل) – প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
- “কলেরা” (الكوليرا, ১৯৪৭) – আধুনিক আরবি কবিতায় বিপ্লব হিসেবে বিবেচিত।
- “শারাপনেল এবং ছাই” (شظايا ورماد, ১৯৪৯)।
- “তরঙ্গের নীচে” (قرارة الموجة, ১৯৫৭)।
- “চাঁদের গাছ” (شجرة القمر, ১৯৬৮)।
- “সমুদ্র তার রঙ পরিবর্তন করে” (يغير ألوانه البحر, ১৯৭৭)।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
নাজিক আল-মালাইকার কবিতা শুধু পাঠককেই স্পর্শ করেনি, শিল্পী ও গবেষকদেরও অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর মেদিনাত আল হাব কবিতা ইরাকি শিল্পী ইসাম আল-সাইদকে একই নামে একটি শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করে।
তাঁর কবিতাগুলো অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, নেপালি সহ বহু ভাষায়। এমিলি ড্রামস্টার অনুবাদে “Revolt under the Sun” গ্রন্থে তাঁর কবিতা স্থান পেয়েছে, আর নেপালি কবি সুমন পোখরেল তাঁর রচনাগুলো নেপালি ভাষাভাষী পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
মৃত্যু ও স্মৃতি
২০০৭ সালে ৮৩ বছর বয়সে নাজিক কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর সাহিত্যিক অবদান আজও আরবি জগতে প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। নারীর কণ্ঠস্বর, মানবিক বেদনা আর আধুনিক কবিতার ঢেউকে তিনি এক অনন্য মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছেন।
নাজিক আল-মালাইকা শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রতিরোধ ও আধুনিকতার প্রতীক। তাঁর কবিতা আজও মধ্যপ্রাচ্যের নারীবাদী আন্দোলন ও মুক্তচিন্তার পথকে আলোকিত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আরব সমাজে তিনি দেখিয়েছিলেন—কবিতা শুধু আবেগ নয়, বরং পরিবর্তনের হাতিয়ার।