বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

| ৩০ আশ্বিন ১৪৩২

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই

‘ধ্বংসের মধ্যেও জীবনের অনন্ত অনুসন্ধান’

প্রতীক ইজাজ

প্রকাশ: ১৮:৫০, ৯ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৫৯, ৯ অক্টোবর ২০২৫

‘ধ্বংসের মধ্যেও জীবনের অনন্ত অনুসন্ধান’

আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের জগতে এমন কিছু নাম আছে, যাদের লেখা পড়লে মনে হয় পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে— কিন্তু শব্দগুলো তবুও জীবনের এক গভীর স্পন্দন তৈরি করে। হাঙ্গেরির লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই (László Krasznahorkai) সেই বিরলদের একজন। তিনি প্রলয়ের দর্শনে ডুবে থাকা ইউরোপের এক নিঃসঙ্গ কথাশিল্পী।

তিনি বিশ্বাস করেন, প্রলয় মানেই শেষ নয়; বরং সেটি মানুষের আত্ম-সন্ধানের মুহূর্ত।

তিনি আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও রহস্যময় কথাসাহিত্যিক। তাঁর লেখা গদ্য দীর্ঘ, জটিল, ঘূর্ণায়মান বাক্য এবং অস্তিত্ববাদী ও প্রলয়ের ভাবনায় ভরপুর শৈলীর জন্য পরিচিত।
তাকে প্রায়ই বলা হয়- ”The contemporary master of apocalypse fiction.” অর্থাৎ, “সমসাময়িক প্রলয়-বিষয়ক কথাসাহিত্যের গুরু।”

জন্ম ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি, হাঙ্গেরির ছোট্ট শহর গিউলাতে। তার সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস Sátántangó দিয়ে, যা পরবর্তীতে আধুনিক কথাসাহিত্যের এক ক্লাসিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

প্রলয়ের ভেতর মানবতার অনুসন্ধান

ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসে পৃথিবী প্রায় সবসময়ই ভেঙে পড়ছে— কোনো না কোনোভাবে। তার চরিত্ররা হাঁটে অন্ধকারে, সময়ের ভেতর ঘূর্ণায়মান, ইতিহাসের ভারে ন্যুব্জ। তিনি যেন লিখেন সভ্যতার এক অবসানগাঁথা, কিন্তু সেই অবসানের ভেতরেই খোঁজেন মানুষ ও শিল্পের অর্থ।

সমালোচকরা তাঁকে বলেন, “A poet of apocalypse — প্রলয়ের কবি”। তাঁর গদ্য কাফকার দার্শনিক গাম্ভীর্য, বেকেটের একাকিত্ব, আর দস্তয়েভস্কির পাপ-প্রায়শ্চিত্তের অনুসন্ধানের এক মিশ্রণ।

উপন্যাস ও চলচ্চিত্র, তীব্র অন্তর্মুখী ভাবনা

ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসগুলো সাধারণত দীর্ঘ বাক্য, ঘন বর্ণনা ও এক ধরনের তীব্র অন্তর্মুখী ভাবনা দিয়ে গঠিত।

তাঁর লেখায় দেখা যায়- সভ্যতার পতন, মানবিক মূল্যবোধের সংকট, ধর্ম, ইতিহাস ও দর্শনের সংঘাত এবং নিঃসঙ্গতা ও উন্মাদনার দার্শনিক অনুসন্ধান।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসগুলো চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন বিখ্যাত হাঙ্গেরীয় পরিচালক বেলা তার (Béla Tarr)। তিনি হাঙ্গেরির এই মহান চলচ্চিত্র নির্মাতার দীর্ঘদিনের সহযোগি ছিলেন।

চলচ্চিত্রে প্রলয়ের রূপান্তর

এই চলচ্চিত্রগুলোতে লেখকের প্রলয়-ভাবনা যেন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে— সময় ধীরে চলে, আলো ম্লান, আর মানবজীবন পরিণত হয় নীরব প্রতীকে।

Sátántangó (স্যাতান্তাঙ্গো, ১৯৮৫)- তাঁর প্রথম উপন্যাস এবং সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ। প্রলয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গ্রামের মানুষের গল্প, যেখানে বাস্তবতা ও বিভ্রমের সীমানা মিলেমিশে যায়। মুলত এই উপন্যাস দিয়েই লাসলোর সাহিত্য জীবনের শুরু। 

পরিচালক Béla Tarr এই উপন্যাস অবলম্বনে ৭ ঘণ্টাব্যাপী একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা এখন ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত- Werckmeister Harmonies (২০০০)। এটি সমাজের ভেতরকার বিশৃঙ্খলার এক ধীরগতি কাব্য। 

The Melancholy of Resistance (১৯৮৯)- তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। এতে একটি ছোট শহরে অদ্ভুত এক সার্কাসের আগমনকে কেন্দ্র করে সভ্যতার অবক্ষয়, ভয়, ও কর্তৃত্বের প্রতীকী রূপ তুলে ধরা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে এক অচল সভ্যতার রূপক। এটিও Béla Tarr-এর বিখ্যাত চলচ্চিত্র Werckmeister Harmonies-এর ভিত্তি।

War and War (১৯৯৯)- উপন্যাস এক সরকারি কর্মচারীর পাগলামির গল্প, যিনি একটি রহস্যময় পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য পৃথিবী ভ্রমণ করেন। মানবসভ্যতার স্মৃতি ও ইতিহাসের অর্থহীনতার গভীর অনুসন্ধান এতে পাওয়া যায়। তিনি তুলে এনেছেন ইতিহাসের ভেতর হারিয়ে যাওয়া এক সরকারি কর্মচারীর আত্মদহন।

Seiobo There Below (২০০৮)-  উপন্যাসটি প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের শিল্প, ধর্ম ও সৌন্দর্যের দর্শন নিয়ে গঠিত। এতে প্রতিটি অধ্যায় ফিবোনাচ্চি ক্রমে সাজানো, যা কাব্যিক ও গাণিতিক শৃঙ্খলার এক অনন্য মিশ্রণ। তাঁর শিল্প ও সৌন্দর্যের দর্শন নিয়ে লেখা এক অনন্য বই। এই বইয়ের জন্য তিনি ‘Man Booker International Prize 2015’ পান।

Baron Wenckheim’s Homecoming (২০১৬)- উপন্যাসটি বুড়ো হয়ে যাওয়া এক অভিজাত ব্যক্তির নিজ শহরে ফেরা এবং তার সঙ্গে সমাজের অবক্ষয়ের গল্প। এটি ‘National Book Award for Translated Literature (2019)-এ বিজয়ী হয়।

অবিরত গড়িয়ে চলে বাক্য

তার বাক্যগুলো কখনও এক পাতায় শেষ হয় না, অবিরত গড়িয়ে চলে, যেন সময়ও থেমে যেতে চায় না। এই ভাষাশৈলীই তাকে করে তুলেছে ‘ধৈর্যের লেখক’, যার পাঠক হতে হলে পাঠককেও হতে হয় এক ধৈর্যশীল সাধক।

তার গদ্য ফ্রানৎস কাফকা, স্যামুয়েল বেকেট এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের প্রভাব বহন করলেও তিনি নিজস্ব এক “অন্ধকার, সংগীতময় ও মহাকাব্যিক বাস্তবতা” নির্মাণ করেছেন।

তার লেখার মুল উপজীব্য- সময় ও ইতিহাসের চক্রাকারতা, মানব অস্তিত্বের অসারতা, সভ্যতার পতন ও প্রলয়ের অনিবার্যতা, ধর্ম, শিল্প ও অর্থহীনতার সংঘাত এবং নিঃসঙ্গ মানুষ ও তার অন্তর্লোক।  

ক্রাসনাহরকাইয়ের লেখা হাঙ্গেরীয় ভাষায় জটিল ও দীর্ঘ বাক্যবিন্যাসে পরিপূর্ণ। তাই ইংরেজি অনুবাদক George Szirtes ও Ottilie Mulzet তাঁর কাজগুলোকে বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

লাসলো ক্রাসনাহরকাইয়ের বিখ্যাত উদ্ধৃতির মধ্যে রয়েছে-
“Everything is burning, everything is in ruins, yet life goes on.”
— László Krasznahorkai, The Melancholy of Resistance

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের আজ বিশ্বসাহিত্যের এমন এক লেখক, যিনি ধ্বংসের গল্প লিখে বেঁচে থাকার নান্দনিকতা শেখান। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন— ”সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও শব্দ টিকে থাকে, আর শব্দের ভেতরেই মানুষ তার পরিত্রাণ খোঁজে।”

পেলেন সাহ্যিতে নোবেল

হাঙ্গেরির বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই পেয়েছেন ২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। স্টকহোমে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে নোবেল কমিটি তার নাম ঘোষণা করে। 

এর আগে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই পেয়েছেন ‘Man Booker International Prize’ (২০১৫), ‘Austrian State Prize for European Literature’ (২০১৪), ‘National Book Award for Translated Literature’ (২০১৯), ‘Best Translated Book Award’ (২০১৩, ২০১৯), ‘Hungarian Literature Prize’- সহ অসংখ্য সম্মাননা।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

পুয়ের্তো রিকোর জালে মেসির আর্জেন্টিনার ৬ গোল
স্বাক্ষরবিহীন ব্যালট পেপার বিতর্কে তোলপাড়
চাকসু নির্বাচন অমোচনীয় কালি উঠে যাওয়ার অভিযোগ
রোম সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস
মিরপুরে অগ্নিকাণ্ডে ৯ জনের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক
মিরপুরের আগুন গার্মেন্টসের দ্বিতীয় তলা থেকে ৯ জনের লাশ উদ্ধার
হাসিনাকে ফেরাতে রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ১৯ অক্টোবরের মধ্যে এনিসিপিকে প্রতীক নিতে হবে
শিশুদের জন্য বিপজ্জনক ভারতের ৩ কফ সিরাপ: ডব্লিউএইচও
বুধবার থেকে শুরু অনলাইন জামিননামা প্রক্রিয়া
শহীদ মিনারে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থান
আগামী রবিবার থেকে মাসব্যাপী শিশু-কিশোরদের বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকাদান শুরু