শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

| ১১ আশ্বিন ১৪৩২

মহালয়া পরবর্তী নবদুর্গা পূজার উপাখ‍্যান...

রাজীব শাঁখারী 

প্রকাশ: ১৪:৫৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মহালয়া পরবর্তী নবদুর্গা পূজার উপাখ‍্যান...

শরতের শুক্লপক্ষের প্রথম দিনই মহালয়া। শাস্ত্রমতে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় মহালয়ার পরের দিন থেকেই। পূজার এই আনুষ্ঠানিকতা নবদুর্গা পূজা হিসেবে পরিচিত। নবদুর্গা পূজা মানে জগৎ জননী মাতা পার্বতীর নয়টি রূপে পূজা করা। মাতার এই নব রূপই হলো নবদুর্গা। কি সেই নয়টি রূপ... আসুন জেনে নেই।


১.শৈলপুত্রী:

মায়ের নবদুর্গার প্রথম রূপ দেবী শৈলপুত্রী। দেবীর ডান হাতে ত্রিশূল আর বাম হাতে পদ্ম। তাই দেবীর অপর নাম শুলধারিণী। তিনি বৃষের উপর চড়েছিলেন বলেই দেবীর আরেক নাম বৃষরুদ্ধা। দেবীর মাথায় শোভা পেয়েছে অর্ধচন্দ্র। রাজা দক্ষর কন্যা সতী দেহত্যাগের পরে পরজন্মে গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার ঘরে দেবী পার্বতী রূপে জন্মগ্রহণ করেন। শৈলরাজের কন্যা হওয়ায় তার নাম হয়  শৈলপুত্রী।

দেবী শৈলপুত্রীর মন্ত্র-

ওম দেবী শৈলপুত্রায় নমঃ ॥

বন্দে বঞ্চিতালভয় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরম্।

বৃষরুধাম শূলধারম শৈলপুত্রিম যশস্বিনিম ॥

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মা শৈলপুত্রী রূপেনা সংস্থিতা।

নমস্তস্যায় নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥

২.ব্রহ্মচারিণী বা তপস্যারিণী: 

মা পার্বতীর নবশক্তির দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণী। কথিত আছে যে---‘বেদস্তত্ত্বং তপো ব্রহ্ম’---বেদ, তত্ত্ব এবং তপ হলো ‘ব্রহ্ম’। দেবী ব্রহ্মচারিণীর রূপে তিনি ডান হাতে জপের মালা এবং বাঁ হাতে কমণ্ডলু ধারণ করে আছেন। পূর্বজন্মের সতী যখন হিমালয়ের কন্যারূপে মহামায়া আদি শক্তি পার্বতী রূপে জন্মেছিলেন তখন তিনি নারদের পরামর্শে ভগবান শঙ্করকে পতিরূপে লাভ করার জন্য কঠিন তপস্যা করেন। সেই কঠিন তপস্যার জন্য তাকে তপস্যারিণী বা ব্রহ্মচারিণী বলা হয়। 

৩.চন্দ্রঘণ্টা: 

দেবী চন্দ্রঘন্টার অপর নাম কল্যাণিকা ও সুমঙ্গলা। মাথায় অর্ধচন্দ্র থাকেয় দেবীকে চন্দ্রঘণ্টা নামে ডাকা হয়। এরূপে দেবীর শরীরের রং স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল এবং দশভুজা। হাতে কমণ্ডলু , তরোয়াল , গদা , ত্রিশূল , ধনুর্বাণ , রক্তপদ্ম , জপমালা, ডমরু, শঙ্খ,  থাকে। বাহন সিংহ। দেবী তার ঘণ্টার ন্যায় প্রচন্ড চন্ড ধবনিতে দুরাচারী রাক্ষস , দানব , দৈত্যদের প্রকম্পিত করেন। 

৪.কুষ্মাণ্ডা: 

দেবী পার্বতীর চতুর্থ স্বরূপে "কুষ্মাণ্ডা" নামে পরিচিতা। নবরাত্রের চতুর্থী তিথিতে ভক্তগণ এই কুষ্মাণ্ডারূপেই আদ্যাশক্তিকে আহ্বান করে থাকেন। করুনায় ভরপুর মায়ের এই সৌম্যপ্রতিমা। এই রূপে দেবী সিংহবাহিণী, ত্রিনয়ণী ও অষ্টভুজা। তাঁর আটটি হাতে সুদর্শনচক্র, ধনুর্বাণ, রক্তপদ্ম, কমণ্ডলু, ইত্যাদি রয়েছে। মায়ের বাম হাতে অমৃতপূর্ণ কলস। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বলিদানের মধ্যে কুমড়ো বলি মায়ের অধিক প্রিয়। কুমড়োকে সংস্কৃতে "কুষ্মাণ্ড" বলে, কুষ্মাণ্ডপ্রিয় দেবী তাই কুষ্মাণ্ডা নামে পরিচিত।

"কুৎসিত উষ্মা সন্তাপস্তাপত্রয়রূপো যস্মিন সংসারে। স সংসারে অণ্ডে উদর রূপায়াং যস্যাঃ।"

অর্থাৎ, সংসার তাপযুক্ত, ত্রিবিধ তাপে জর্জরিত। সেই সংসারকে যিনি ভক্ষণ করেন, তিনিই কুষ্মাণ্ডা। কু- কুৎসিত, উষ্মা সন্তাপত্রয়ে পূর্ণ জগৎ যাঁর অণ্ডে (উদরে) বিদ্যমান, তিনিই কুষ্মাণ্ডা।

৫.স্কন্দমাতা: 

কার্তিকের আরেক নাম স্কন্দ। তাই কার্তিকের মাতা হওয়ায় নবরাত্রির পঞ্চম রাতে দেবী পার্বতী পূজিত হন স্কন্দমাতা রূপে। ত্রিনয়ণী দেবী চার হাতবিশিষ্টা। ডানদিকের উপরের হাতে আছেন শিশু কার্তিক। আর  প্রস্ফুটিত পদ্ম থাকে আরেক হাতে।  বাঁ পাশের একটি হাত বরও অভয় দিচ্ছেন আর অন‍্য হাতে আছে পদ্ম। এই রূপে দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। আর তিনি বসে আছেন প্রস্ফুটিত কমলে। পূজিত হন নবরাত্রির পঞ্চমদিনে।

৬.কাত্যায়নী: 

এই নাম এবং রূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক এক কাহিনি। বৈদিক যুগে কাত্যায়ন নামক এক মহাঋষির ছিলো এক পুত্র। তিনি  একটি কন্যাসন্তানের আশায় দেবী পার্বতীর তপস্যা করে অভীষ্ট পূর্ণ করেন। তার স্তবে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং দেবী পার্বতী জন্ম নেন মহাঋষি কাত্যায়নের কন্যা সন্তানরূপে। তখন তার নাম হয় কাত্যায়নী। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে আরাধিতা হন ভক্তদের কাছে। দেবী পার্বতী এই রূপ নিয়ে মহিষাসুর কে বধ করেন।

৭.কালরাত্রি: 

এখানে দেবী কৃষ্ণবর্ণা। বিক্ষিপ্ত কেশে তিনি ধাবিত শত্রুর দিকে। তার কণ্ঠে বিদ্যুতের মালা। ত্রিনয়নী দেবীর শ্বাস প্রশ্বাসে বেরিয়ে আসে আগুনের ফুল্কি। উগ্রদর্শনা দেবীর তিন হাতে অস্ত্র এবং এক হাতে ভক্তদের প্রতি বর ও অভয় প্রদান ভঙ্গি। দেবী কালিকা রূপে উপাসিত হন এবং ভক্তদের শুভাশিষ প্রদান করেন। তাই তিনি শুভঙ্করিণী নামেও পূজিত। দেবীর বাহন গর্দভ। ভক্তরা তার পুজো করেন নবরাত্রির সপ্তম রাতে |

৮.মহাগৌরী: 

কথিত আছে হিমায়লকন্যা ছিলেন গৌরবর্ণা। শিবের তপস্যা করে রৌদ্রে তিনি কৃষ্ণা হন। মহাদেব যখন গঙ্গাজল দিয়ে তাকে স্নান করান, তখন তিনি হয়ে ওঠেন ফর্সা। তখন তাঁর এই রূপের নাম হয় মহাগৌরী। প্রচলিত বিশ্বাস, নবরাত্রির অষ্টম রাতে তার পুজো করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। সাদা পোশাক পরিহিতা, চার হাত বিশিষ্টা দেবীর বাহন ষাঁড়। দেবীর এক হাত শোভিত বর-অভয় মুদ্রায় আর বাকি তিন হাতে থাকে পদ্ম, ত্রিশূল এবং ডমরু। দেবী এই গৌরী রূপে অষ্ট বর্ষি বালিকা রূপে শিব কে নৃত্য করে প্রমোদ দেন পরে শিব তার পরিচয় জানতে চাইলে দেবী পার্বতী নিজের রূপ প্রকাশ করেন।

৯.সিদ্ধিদাত্রী: 

নবদুর্গার নবম তথা শেষ রূপ হল সিদ্ধিদাত্রী। সিংহবাহিনী দেবীর চার হাতে আশীর্বাদী মুদ্রা। তিনি সিদ্ধি দান করেন। অর্থাৎ‍ তার উপাসনায় সংসারে আসে সুখ এবং সমৃদ্ধি। ভগবত্‍ পুরাণে আছে, স্বয়ং মহাদেব দেবী পার্বতী কে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পুজো করেছিলেন এবং তার ফলে মহাদেব সকল সিদ্ধি লাভ করেন। সিদ্ধিদাত্রীর আশীর্বাদেই সর্ব সিদ্ধি লাভ করেন মহাদেব।

বাংলাদেশে নবদুর্গা পূজা:

বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলের ৫০০ বছরেরও বেশি পুরোনো মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরে শুরু হয়েছে নয় দিনব্যাপী বিশেষ ‘নবদুর্গা পূজা’। দেবী দুর্গার নয়টি ভিন্ন রূপের আরাধনাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই অনন্য উৎসবকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত পুণ্যার্থী সমবেত হয়েছেন।
 

আগামী রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে এই উৎসব শুরু হবে। হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই নয় দিনে দেবী দুর্গা শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী সহ নয়টি ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশের অল্প কয়েকটি স্থানের মধ্যে মঙ্গলচণ্ডী মন্দির অন্যতম, যেখানে এই প্রাচীন ঐতিহ্যটি প্রতি বছর নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়।

মন্দির প্রাঙ্গণে মেলা বসেছে এবং ভক্তরা সুশৃঙ্খল পরিবেশে পূজায় অংশ নিচ্ছেন।

শ্রীমঙ্গলের এই নবদুর্গা পূজা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। ভক্তদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার পাশাপাশি, এই উৎসবটি দেশের অনন্য ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলো রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তাকেও সামনে নিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন