বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫

| ২১ কার্তিক ১৪৩২

নিউইয়র্কে প্রগতির জয়, বাংলাদেশে ধর্মীয় উচ্ছ্বাস

প্রকাশ: ০১:৫৬, ৬ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০২:০৩, ৬ নভেম্বর ২০২৫

নিউইয়র্কে প্রগতির জয়, বাংলাদেশে ধর্মীয় উচ্ছ্বাস

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন মামদানি। ছবি: সিএনএন

জোহরান মামদানি—নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে বিজয়ের পর তার নাম এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহুজাতিক, বহুসাংস্কৃতিক শহরে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এক তরুণের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে এক বড় অর্জন।

কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক মুসলমান এই জয়কে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে অভিনন্দনের বন্যা—‘একজন মুসলমান মেয়র জিতেছেন’, ‘আমাদের গর্ব’, ‘ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে এটি এক জবাব’। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আনন্দের যৌক্তিকতা কোথায়? মামদানি কি সত্যিই মুসলমান, নাকি তিনি মূলত এক মানবতাবাদী প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতীক?

জোহরান মামদানির নাম শুনে সহজেই ধারণা করা যায়, তিনি মুসলমান পরিবার থেকে আসা। আংশিকভাবে সেটি সত্য। তার বাবা মাহমুদ মামদানি একজন মুসলমান বুদ্ধিজীবী, যিনি আফ্রিকার উপনিবেশবাদ, জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন। তবে তার মা মীরা নায়ার ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি হিন্দু পরিবার থেকে আসা এবং সব সময়ই নিজেকে ধর্মের চেয়ে মানবিকতার প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেছেন।

মীরা নায়ারের তৈরি ‘সালাম বোম্বে’ বা ‘দ্য নেমসেক’–এর মতো চলচ্চিত্রগুলোতে দেখা যায়, সমাজের প্রান্তিক মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি, যা তার পুত্র জোহরানের রাজনৈতিক দর্শনেও প্রভাব ফেলেছে।

জোহরান মামদানি জন্মেছেন ও বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনা পুরোপুরি আমেরিকান বাস্তবতায় গড়ে উঠেছে। তিনি কখনো নিজেকে কেবল কোনো ধর্মীয় পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করেননি। বরং তার রাজনৈতিক পরিচয় প্রগতিশীল, সমাজতান্ত্রিক ও মানবিক। তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির সোশ্যালিস্ট ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, যাদের মূল লক্ষ্য করপোরেট প্রভাব কমিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা করা। তার নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মীয় বিষয় ছিল না, বরং কেন্দ্রবিন্দু ছিল সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, অভিবাসীদের অধিকার এবং সাশ্রয়ী বাসস্থান।

তাহলে তার জয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের এতো উচ্ছ্বাস কেন? এর পেছনে কাজ করছে দীর্ঘদিনের এক মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা—বিশ্ব রাজনীতিতে মুসলমানদের সংকুচিত অবস্থান থেকে উঠে আসা আত্মপরিচয়ের সংকট। মুসলিম বিশ্ব আজ বিভিন্ন কারণে বিপর্যস্ত: কোথাও যুদ্ধ, কোথাও দারিদ্র্য, কোথাও স্বৈরশাসন। ফলে পশ্চিমে কোনো মুসলিম নামধারী ব্যক্তি সফল হলেই আমরা তাকে পুরো মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি বানিয়ে ফেলি। সেই পুরোনো অভ্যাস থেকেই জোহরান মামদানি নামের সঙ্গে আমরা এক ধরনের ধর্মীয় গর্ব জুড়ে দিচ্ছি, যদিও তার রাজনীতি ধর্মের সীমার বাইরে।

জোহরান মামদানির প্রতি মুসলমান সমাজের আগ্রহ বেড়ে যায়, যখন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সম্ভাব্য নিউইয়র্ক সফর প্রসঙ্গে বলেন, ‘নেতানিয়াহু যদি আমার শহরে আসেন, আমি চাই তাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হোক।’ এই বক্তব্য দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়ে, এবং তাকে ‘গাজার কণ্ঠ’ বলা শুরু হয়। অনেকেই ধরে নেন, তিনি মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছেন। কিন্তু মামদানি নিজে কখনো বলেননি, তিনি ধর্মীয় কারণে এই অবস্থান নিয়েছেন। তার বক্তব্য ছিল মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক—যে কোনো অন্যায় বা যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত। তার এই অবস্থান আসলে মানবতার, ধর্মের নয়।

এই বাস্তবতায় মামদানির জয়ে ধর্মীয় গর্ব খোঁজা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। কারণ, তার রাজনৈতিক দর্শন দাঁড়িয়ে আছে মানবিক ন্যায়, সমতা ও নাগরিক স্বাধীনতার ওপর। তিনি বলেন, ‘আমি এমন এক শহর চাই, যেখানে কেউ বর্ণ, ধর্ম বা শ্রেণির কারণে পিছিয়ে থাকবে না।’ তার শহর-দর্শনে ইসলাম, হিন্দু বা ইহুদি নয়—বরং মানুষই মূল বিষয়। নিউইয়র্কের বৈচিত্র্যই তার কাছে রাজনীতির মূল শক্তি।

বাংলাদেশে এই বিষয়টি অনেকেই উপেক্ষা করছেন। এখানে ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে বিদেশি সাফল্য উদযাপনের প্রবণতা নতুন নয়।

একসময় আমরা লন্ডনের মেয়র সাদিক খানের জয়ে একইভাবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। কিন্তু সাদিক খানও তার রাজনীতিতে ইসলাম নয়, নাগরিক কল্যাণ, সমতা ও সামাজিক ন্যায়ের কথা বলেন। এভাবে আমরা বারবার ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে প্রকৃত মূল্যবোধের জয়কে অবহেলা করি।

জোহরান মামদানির পারিবারিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা তাকে এক বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছে। তার মা হিন্দু, বাবা মুসলমান, কিন্তু তাদের দুজনেরই চেতনা ধর্মীয় বিভাজন নয়, বরং মুক্তচিন্তা ও মানবতা। তার মা যেমন সিনেমায় সমাজের নিপীড়িত মানুষকে তুলে ধরেছেন, তিনিও রাজনীতিতে সেই মানুষগুলোর কণ্ঠস্বর হতে চেয়েছেন। ফলে তার বিজয়কে কেবল ‘মুসলমানের জয়’ বলা তার আদর্শকে খাটো করা।

তার বিজয়ের প্রকৃত তাৎপর্য হলো—নিউইয়র্কের মতো একটি শহরে বৈচিত্র্যের জয়, মানবিকতার জয়, প্রগতিশীল চিন্তার জয়। এই শহরে তাকে ভোট দিয়েছে ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু, মুসলমান, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো—সব সম্প্রদায়ের মানুষ। তার বিজয় ধর্মীয় নয়, নাগরিক ঐক্যের প্রতীক।

বাংলাদেশে অনেকেই মনে করেন, তার মুসলিম বংশোদ্ভূত পরিচয় আমাদের গর্বের বিষয়। কিন্তু যদি গর্ব করতেই হয়, তা হওয়া উচিত তার সাহস, নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই মূল্যবোধগুলোই আসলে ইসলামের মৌলিক চেতনার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ—যদিও তিনি নিজেকে ধর্মীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেন না।

আমাদের সমাজে ধর্মীয় উচ্ছ্বাসের জায়গায় যদি মানবিক ন্যায়বোধের গুরুত্ব দেওয়া যেত, তবে এই বিজয় থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারতাম। যেমন, রাজনীতি কেবল ক্ষমতার জন্য নয়, মানুষের কল্যাণের জন্য হওয়া উচিত। মামদানি তার শহরের মানুষের জীবনযাত্রা বদলাতে চান—এই ইচ্ছাটিই তাকে প্রকৃত রাজনীতিক করে তুলেছে।

তার বাবা মাহমুদ মামদানি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ধর্মকে আমি নৈতিক অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখি, কিন্তু রাজনীতিতে এটি কখনোই একমাত্র পরিচয় হতে পারে না।’ এই ভাবনাই হয়তো পুত্রের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রভাবিত করেছে। জোহরান মামদানি তার রাজনীতিতে ধর্মকে নয়, মানুষকে কেন্দ্র করেছেন।

বাংলাদেশে যদি আমরা তার এই রাজনীতি থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তবে সেটিই হবে আমাদের প্রকৃত অর্জন। আমাদের রাজনীতিতে এখনো ব্যক্তিপূজা, দলীয় আনুগত্য ও ধর্মীয় বিভাজনই মুখ্য। মানবিক মূল্যবোধ, সমতা ও ন্যায়বিচার—এসব কেবল বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ।

মামদানি দেখিয়েছেন, রাজনীতি কেমন হতে পারে—মানুষকেন্দ্রিক, নীতিনিষ্ঠ ও সাহসী। অতএব, জোহরান মামদানি মুসলমান কি না, সেটি এখন মূল প্রশ্ন নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান এবং ধর্মের দেয়াল পেরিয়ে মানবতার রাজনীতি করতে চান।

তার বিজয় প্রমাণ করেছে, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় আদর্শ ও সততা দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করা যায়। তার জয় ধর্মের নয়, বরং ন্যায় ও মানবতার জয়। বাংলাদেশি মুসলমানদের আনন্দ তাই অস্বাভাবিক নয়, তবে সেটি যেন অন্ধ ধর্মীয় গর্ব না হয়। আমরা যদি এই বিজয় থেকে মানবিক রাজনীতির অনুপ্রেরণা নিতে পারি, তবেই এই আনন্দ অর্থবহ হবে।

জোহরান মামদানি আজ এক প্রজন্মের কাছে প্রমাণ করেছেন, বিশ্ব রাজনীতিতে সফল হওয়ার জন্য ধর্ম নয়, দরকার সততা, চিন্তা ও সাহস। তার জয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের জয়ই আসল জয়।

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

এবার বিএনপিতে যোগ দিলেন রেজা কিবরিয়া
ফিক্সিংয়ে অভিযুক্ত খেলোয়াড়রাই থাকছেন বিপিএলে
ঋষভ পান্থের দাপুটে প্রত্যাবর্তন, বাদ মোহাম্মদ সামি
ঋষভ পান্থের দাপুটে প্রত্যাবর্তন, বাদ মোহাম্মদ সামি
স্যান্টনারের ঝড়ো লড়াইও হার এড়াতে পারেনি নিউজিল্যান্ড
মামদানিকে অভিনন্দন জানালেন ওবামা
ভারত-নেপালের জন্য ২৭ সদস্যের দল ঘোষণা করল বাংলাদেশ
স্টার সিনেপ্লেক্সে ‘হুমায়ুন আহমেদ সপ্তাহ’ শুরু, একটি টিকিটে আরেকটি ফ্রি!
ইয়ামাল রিয়ালে খেলার অযোগ্য
বিপাকে সালমান, খেলেন বিজেপি নেতার নোটিশ
সহজ ম্যাচ কঠিন করে জিতল পাকিস্তান
অস্ত্র চুরির বিষয়টি তদন্তাধীন, রিপোর্ট পেলে বলা যাবে: স্বরাষ্ট্র সচিব
তানজিন তিশার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা
‘দেশের সংকটে আগুনে ঘি ঢেলে দেয় প্রথম আলো’: নাসীরুদ্দীন
পাঁচ ইসলামি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ : গভর্নর
কিউএস এশিয়া র‌্যাঙ্কিংয়ে এবারও দেশসেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণসংযোগকালে চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থী গুলিবিদ্ধ
সুযোগ বারবার আসে না: নজরুল ইসলাম খান
ঢাকার বাইরে বিমানবাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণের সুপারিশ
নির্বাচনের আগেই গণভোট চায় জামায়াত