শীর্ষ ১০ মার্কিন ধনকুবেরের সম্পদ বেড়েছে ৬৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলার
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪:৩৪, ৩ নভেম্বর ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ ধনকুবের
গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ ধনকুবেরের সম্পদ বেড়েছে ৬৯ হাজার ৮০০ কোটি (৬৯.৮ বিলিয়ন) ডলার। আন্তর্জাতিক দাতসংস্থা অক্সফাম আমেরিকা সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, এই বিপুল সম্পদবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রে ধনী-গরীবের ব্যবধানকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদবণ্টনের চিত্র এখন এতটাই অসম যে দেশটির এক ভাগ ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে অজস্র সম্পদ ও ক্ষমতা, যেখানে কোটি কোটি মানুষ বেঁচে আছেন ন্যূনতম আয়ের কষ্টে।
১৯৮৯ থেকে ২০২২ সালের ফেডারেল রিজার্ভের তথ্য ব্যবহার করে অক্সফামের গবেষকেরা দেখিয়েছেন, শীর্ষ ১ ভাগ পরিবার মধ্যম আয়ের পরিবারের তুলনায় ১০১ গুণ বেশি সম্পদ অর্জন করেছে। সমাজের নিচের ২০ ভাগ পরিবারের তুলনায় এই ব্যবধান ৯৮৭ গুণ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের প্রবাহ চলেছে কেবল একদিকে—শীর্ষ স্তরে।
গবেষণায় দেখা যায়, শীর্ষ এক ভাগ পরিবারের প্রত্যেকে গড়ে ৮.৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যেখানে সাধারণ আমেরিকান পরিবার পেয়েছে মাত্র ৮৩ হাজার ডলার। এমন বৈষম্যমূলক আর্থিক ব্যবধান এখন বিশ্বের অন্যতম উন্নত অর্থনীতিকেও নড়বড়ে করে দিচ্ছে।
অক্সফাম জানায়, মার্কিন জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ নিম্ন-আয়ের হিসেবে শ্রেণিভুক্ত। শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ৫০ ভাগ ছুঁয়েছে। একই সঙ্গে, ৩৮ টি উচ্চ-আয় সম্পন্ন দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে আপেক্ষিক দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি, শিশুমৃত্যু হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, আর গড় আয়ু দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
এই পরিসংখ্যান কেবল অর্থনৈতিক অসমতা নয়—একটি সভ্য সমাজে মানবিক অবক্ষয়েরও প্রতিচ্ছবি।
অক্সফাম আমেরিকার অর্থনৈতিক ন্যায় বিষয়ক সিনিয়র নীতি পরিচালক রেবেকা রিডেল মন্তব্য করেন—“বৈষম্য কোনও অঘটন নয়; এটি নীতি-নির্বাচনের ফল। আমরা চাইলেই ভিন্ন নীতি নিয়ে দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে পারি।”
রিডেলের মতে, গত দুই দশক ধরে মার্কিন কর ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা ও শ্রমিক অধিকার দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর ফলে ধনীরা যেভাবে নিজেদের সম্পদকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায় রূপান্তরিত করছেন, তা ‘ডেমোক্রেটিক ক্যাপিটালিজম’-এর মৌল দর্শনকেই চ্যালেঞ্জ করছে।
অক্সফাম আমেরিকা সতর্ক করেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনিক নীতির ফলে ধনীদের পক্ষে কর ছাড়, বেসরকারি কর্পোরেট প্রণোদনা ও বাজার-কেন্দ্রিক বিনিয়োগ নীতিগুলো আরও বেশি ধনীদের সুবিধা দেবে। যদিও রিপোর্টে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কেবল রিপাবলিকান নয়—ডেমোক্র্যাট প্রশাসনগুলিও বছরের পর বছর এই বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য সমানভাবে দায়ী।
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ বলছে, মার্কিন শেয়ারবাজারের অতি-উচ্চ মূল্যায়ন, কর ছাড় ও অসীম প্রণোদনা ধনী শ্রেণির সম্পদকে বৃদ্ধি করে তুলেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্তরে। শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই এই শীর্ষ ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধি গড় ৭০ হাজার কোটি ডলারের মতো, যা প্রায় বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটের দেড় গুণ।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮০-এর দশক থেকে মার্কিন কর নীতিতে ধনীদের জন্য বারবার ছাড় ও রেয়াত দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে শ্রমিকদের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, ও সামাজিক সুরক্ষার বিধানগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে গেছে। এর ফলে শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধনীরা নিজেদের ক্ষমতা আরও মজবুত করেছেন।
অক্সফাম রিপোর্টে উল্লেখ আছে, এখন ধনীরা কেবল অর্থনৈতিক ভাবেই নয়, রাজনৈতিক ভাবেও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অধিক প্রভাব ফেলতে পারছেন। এভাবে একটি “Wealth Power Cycle” তৈরি হচ্ছে—যেখানে সম্পদ ক্ষমতা বাড়ায়, আর ক্ষমতা ফিরে সম্পদকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে যদিও সামগ্রিক দারিদ্র্য হার গত দশকে কমেছে, তবু সম্পদের অসম বণ্টন দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫-এর শেষার্ধে বাংলাদেশের শীর্ষ ৫ ভাগ পরিবার দেশের মোট আয়ের প্রায় ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে—এ তথ্য অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক আঞ্চলিক রিপোর্টেও আছে।
এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “মার্কিন বৈষম্য” হলো একটি অভিজ্ঞতার আয়না যা দেখিয়ে দিচ্ছে, যদি দেশীয় কর নীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকে, তাহলে ধনীরা সবসময়ই আরও ধনী হতে থাকবেন।
অক্সফাম আমেরিকার রিপোর্টটি শেষ হয়েছে একটি সতর্ক বার্তায়—“বৈষম্য প্রাকৃতিক নয়, এটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল। অতএব, পরিবর্তনের ক্ষমতাও আমাদের হাতে।”
বিশ্ব যখন ক্লাইমেট সংকট, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দার চাপে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখন কিছু অতি-ধনী মানুষের হাতে এভাবে অসীম সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া মানবসভ্যতার জন্যই বিপজ্জনক।
অর্থনীতির মূল নীতি হলো “সবার জন্য ন্যায়বিচার”—কিন্তু ধনীদের জন্য যদি সবকিছু এমন ভাবে নকশা হয় যে গরিবরা প্রতিনিয়ত আরও পিছিয়ে পড়েন, তাহলে সমাজ আর রাষ্ট্র দু’টোই অবশেষে অসাম্য ও অস্থিরতায় ডুবে যাবে।
