৫০০ বছর পর রাজা চার্লস-পোপ লিও’র একত্রে প্রার্থনা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯:৪৬, ২৩ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০৪:০৮, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস ও ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে পোপ লিও’র যৌথ প্রার্থনা। ছবি : রয়টার্স
৫০০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজা চার্লস ও পোপ লিও একসঙ্গে জনসমক্ষে প্রার্থনা করেছেন—এবং এর তাৎপর্য বিশাল। এই প্রার্থনার ইতিবৃত্ত নিয়ে রয়টার্স এক বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সব গনমাধ্যমেই এই খবর গুরুত্ব পেয়েছে।
ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে পোপ লিও’র সঙ্গে রাজা চার্লসের প্রার্থনার দৃশ্যটি ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও অ্যাংলিকান কমিউনিয়নের মধ্যে পাঁচ শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া বিভেদের পর ঐতিহাসিক পুনর্মিলনের প্রতীক।
সিস্টিন চ্যাপেলে রাজা চার্লসের প্রার্থনা
রাজা হিসেবে চার্লস ইংল্যান্ডের চার্চের সুপ্রিম গভর্নর এবং তিনি রাজা অষ্টম হেনরির উত্তরসূরি—যিনি ১৫৩৪ সালে রোমান চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন, মূলত নিজের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে উত্তরাধিকারী পাওয়ার আশায় পুনরায় বিয়ে করার উদ্দেশ্যে।
দুই চার্চের সম্পর্ক গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়েছে। কিন্তু ইংলিশ রিফরমেশনের পর কোনো ইংরেজ সম্রাট ও ক্যাথলিক পোপের একত্রে প্রার্থনায় অংশ নেওয়া এই প্রথম। ক্যাথোলিক হেরাল্ড এই ঘটনাকে বর্ণনা করেছে “রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে খ্রিস্টান ঐক্যের প্রকৃত অগ্রগতি” হিসেবে।
সেবার সময় রাজা চার্লস পোপের বাঁ পাশে বসেছিলেন। পোপ লিও ও অ্যাংলিকান আর্চবিশপ স্টিফেন কট্রেল প্রার্থনা পরিচালনা করেন।
বিকেলে রাজা চার্লস রোমের ব্যাসিলিসা অব সেন্ট পল আউটসাইড জন্য ওয়ালস গির্জায় যান—যা ক্যাথলিকদের অন্যতম পবিত্র চারটি গির্জার একটি। সেখানে পোপ লিও তাকে “রয়্যাল কনফ্রাটার” (অর্থাৎ ভাই) উপাধিতে ভূষিত করেন।
রাজাকে উপহার হিসেবে একটি বিশেষ কাঠের আসনও দেওয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতে শুধু ব্রিটিশ রাজাদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। চেয়ারটিতে খোদাই করা আছে রাজা চার্লসের রাজচিহ্ন এবং একতা-বাণী “Ut unum sint” (অর্থাৎ “যেন তারা এক হয়”)।
দুই চার্চের জন্য এই প্রার্থনা কেন প্রতীকী
১৫৩৪ সালে ইংল্যান্ডের চার্চ রোমের পোপের কর্তৃত্ব থেকে আলাদা হয়ে যায়, কারণ পোপ ক্লেমেন্ট সপ্তম রাজা হেনরির প্রথম বিবাহ বাতিল করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
রাজা হেনরি এরপর অ্যান বোলিনকে বিয়ে করেন, যিনি ছিলেন তার ছয় স্ত্রীর মধ্যে দ্বিতীয়। বিচ্ছেদের পর ইংল্যান্ডের চার্চ প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলনের অনেক নীতি গ্রহণ করে। তবু আজও ক্যাথলিক ও অ্যাংলিকান শিক্ষায় বহু মৌলিক বিষয়ে মিল থাকলেও উল্লেখযোগ্য মতভেদ রয়ে গেছে।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ব্রিটেনে ক্যাথলিকদের নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়; তাদেরকে “পোপের প্রতি আনুগত্যশীল” হিসেবে সন্দেহ করা হতো।
১৮২৯ সালে সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে ক্যাথলিকদের সরকারি পদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
২০১৩ সালে সিংহাসনের উত্তরসূরির ক্যাথলিককে বিয়ে করার ওপর ৩০০ বছরের পুরনো নিষেধাজ্ঞাও বাতিল হয়।
চার্লসের বহুধর্মীয় সহাবস্থান ও মত
রাজা চার্লস দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের পক্ষে কাজ করে আসছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বলেছিলেন, তিনি ডিফেন্ডার অব ফেইথ (সব ধর্মের রক্ষক) হিসেবে পরিচিত হতে চান, ডিফেন্ডার অব ফেইথ শুধু খ্রিস্টান বিশ্বাসের রক্ষক নয়—যা অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, কারণ তিনি নিজেই ইংল্যান্ডের চার্চের প্রধান।
ইংল্যান্ডের চার্চ ৪৬টি স্বায়ত্তশাসিত চার্চের একটি, যা ১৬৫টি দেশে বিস্তৃত অ্যাংলিকান কমিউনিয়নের অংশ। তবুও ব্রিটিশ রাজাদের আনুষ্ঠানিক উপাধিতে এখনো ডিফেন্ডার অব ফেইথ আছে—যা মূলত পোপের পক্ষ থেকেই একসময় হেনরি অষ্টমকে প্রদান করা হয়েছিল, রোম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সিংহাসনে আরোহণের পর চার্লস বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেন,“আমি নিজেকে বাধ্য মনে করি তাদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে, যারা অন্য আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করেন, অথবা যারা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের আলোকে জীবনযাপন করতে চান।”
এই যৌথ প্রার্থনা তাই শুধু চার্চ-রাজনীতির ইতিহাস নয়—বরং দুই শতাব্দীর বিভেদ পেরিয়ে মানবিক, ধর্মীয় ও ঐক্যবোধের এক গভীর বার্তা।
