শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

| ৮ কার্তিক ১৪৩২

হত্যার পর স্বামীর লাশ মমি! 

অন্যরকম ডেস্ক

প্রকাশ: ০০:১২, ২৪ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০১:২০, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

হত্যার পর স্বামীর লাশ মমি! 

ইতিহাসে এটি একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। স্বামীকে হত্যার পর তার লাশ রাসায়নিক দিয়ে মমি করে টানা ১৮ বছর উঠোনে রেখেছিলেন স্ত্রী।

পিপল ম্যাগাজিন জানায়, জন সাবিন ও তার স্ত্রী লেই অ্যান সাবিন ব্রিটেনে বাস করতেন। ১৯৯৭ সালে জন হঠাৎ নিখোঁজ হন, তখন তার বয়স ছিল ৬৭ এবং লেইয়ের ৫৬ বছর । জন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সেইসময় লেইকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি এনে দেয়।

জন  ও লেই সাবিনের রোম্যান্স চার দশক ধরে চলেছিল। ব্রিস্টল পোস্টের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জনের সঙ্গে পরিচয়ের সময় লেই ছিল একজন নার্স। তার বয়স ছিল ১৭ এবং জনের ২৮। তখন জন ছিলেন বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। তবুও তারা প্রেমে পড়েন। দুর্বার প্রেমের টানে তারা ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন। বিয়ের পর লেই অন্তঃসত্ত্বা হলে প্রথম স্ত্রী জনকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বাকি জীবন তিনি লেইয়ের সঙ্গেই কাটিয়েছেন।

জন নিখোঁজ হওয়ার পর পাড়াপড়সি ও বন্ধুদের কাছে লেই তার স্বামীকে ভালোবাসার কথা বলতেন। এমন কথাও বলতেন, জনকে ছাড়া তার জীবন চলছে না। তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। জনের নিরুদ্দেশ হওয়ার ১৮ বছর পর ২০১৫ সালে সবকিছু উলোটপালট হয়ে যায়। অবশ্য ততদিনে ৭৪ বছর বয়সে ব্রেইন ক্যানসারে লেইয়ের মৃত্যু ঘটেছে।

জন এবং লেইয়ের পরিচিতজনরা বলেছেন, অজ্ঞাত কারণে তারা ব্রিটেন থেকে নিউজিল্যান্ড চলে যান। তারপর যান অস্ট্রেলিয়া। অনেকদিন পর তারা আবার ব্রিটেনে ফিরে আসেন। ওয়েলসের বেডাউ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।

দ্য নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লেই এবং জন অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার আগে অকল্যান্ডের এক শেল্টার হোমে পাঁচ সন্তানকে রেখে গিয়েছিলেন। সেইসময় তাদের বয়স ছিল পাঁচ থেকে এগারো বছর। হোমে রেখে আসার পর তারা আর কখনো সন্তানদের খোঁজ নেননি।

তখন ছিল ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস। জনের হারিয়ে যাওয়ার কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ মিশেল জেমস নামে এক নারীর মনে পড়ল, তার ভাড়াটিয়া লেই সাবিন একবার বাড়ির উঠোনে মোটা প্যাকেটে একটি মেডিকেল কঙ্কাল রাখার কথা বলেছিলেন। নার্সের প্রশিক্ষণ নিতে তিনি এই কঙ্কালটি কিনেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। তার আরও মনে পড়ে, ২০১৫ সালের অক্টোবরে মারা যাওয়ার আগে লেই প্রায়ই তার বাড়ির পরিচারিকা লিনি উইলিয়ামকে বলতেন, উঠোনের প্যাকেটটি সরিয়ে ফেল। তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, এর ভেতরে বিশেষ ব্যবস্থায় একটি মৃতদেহ রাখা রাখা আছে। কিন্তু তখন তিনি বিষয়টি আমলে নেননি।

লেই মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর জেমস ও তার বন্ধু রিয়ান লি একদিন সিদ্ধান্ত নেন, তারা সেই মেডিকেল কঙ্কালটি ব্যবহার করবেন। কিন্তু যখন তারা প্যাকেটটি খুললেন, তখন মৃতদেহ থেকে তরল তাদের হাতে ছড়িয়ে পড়ল।

মৃতদেহটি টিনের ফয়েল ও প্লাস্টিকের মোড়কে রাসায়নিক দিয়ে মোড়ানো ছিল। জেমস দেখলেন, লাশটির হাত আংশিক পচে গেছে। বিবিসিকে জেমস বলেছেন, এটা দেখার পর আমি চিৎকার দিয়ে বলতে থাকি, এটা একটা মৃতদেহ! এটা একটা মৃতদেহ! এটা দেখে আমরা ভয় পেয়ে যাই। তখন পুলিশে ফোন দিই।

থানা থেকে পুলিশ আসে এবং লাশটি নিয়ে যায়। এই ঘটনা নিয়ে সাউথ ওয়েলস পুলিশের কর্মকর্তা জয় নিকোলস তখন স্কাই টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওটা মেডিকেল কঙ্কাল ছিল না। ওটা ছিল জনের লাশ। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

পুলিশের ল্যাবে একজন প্যাথলজিস্ট সেটি পরীক্ষা করে বলেছিলেন, দেহটি একজন পুরুষ মানুষের এবং ভোঁতা কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এবং লাশটি রাসায়নিক দিয়ে মমি করে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

পরে ডিএনএ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সাবিনের বাড়ির উঠোনে পাওয়া মৃতদেহটি আসলে তার স্বামী জনেরই ছিল।

২০১৬ সালে সাউথ ওয়েলসের গোয়েন্দা প্রধান পরিদর্শক গ্যারেথ মরগান দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছিলেন, লেই সাবিনই জন সাবিনকে হত্যা করেছেন। তবে তার মৃত্যু সম্পর্কে অন্য কেউ জানতো এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এদিকে, ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছিল, লেই অ্যান সাবিন জীবিত থাকতে কখনও খ্যাতি পাননি। তবে সিডনির অভিজাত নাইট ক্লাবে সেলিব্রিটি গায়িকা হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ব্রিটেনে ফিরে এসে সাবিন তার বন্ধুদের বলতেন যে, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় সুপার মডেল ছিলেন। কখনোও কখনোও বলতেন, তিনি একজন মিলিয়নেয়ারের প্রাক্তন স্ত্রী ছিলেন। বাস্তবে তিনি এগুলোর কোনোটাই ছিলেন না।

পেশাগত জীবনে কোরিয়ান যুদ্ধের সময় জন হিসাবরক্ষক ছিলেন। লেই তখন সংসার এবং সন্তানদের দেখাশোনা করতেন। কিন্তু তারা ১৯৬৫ সালে অদৃশ্য হয়ে যান। পরে জানা যায়, জনের বিরুদ্ধে ৬ হাজার ডলার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগ থেকে বাঁচতেই দেশান্তরী হন তারা। 

ডেইলি মেইল জানায়, আদালতে ভ্যালেরি চকলি নামে লেইয়ের এক বান্ধবী সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, জন নিরুদ্দেশ হওয়ার পর লেই ঠাট্টা করে বলেছিলেন, আমি জনকে পাথরের একটি ব্যাঙ দিয়ে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলেছি। কারণ, সে আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। প্রতি রাতে সে বিছানায় কাঁদতে কাঁদতে বলতো, তুমি আমাকে পছন্দ করো না। আমি এতে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। চকলি একে ঠাট্টা মনে করেছিলেন। তাই এসবের কোনোটিকেই গুরুত্বের সঙ্গে নেননি।

২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত  শুরু করে। ডিএনএ বিশ্লেষণে জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, তখনও তার লাশে মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের পায়জামা পরা ছিল

ময়নাতদন্ত শেষে ডাক্তার অ্যান্ড্রু বার্কলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, জনকে খুন করা হয়েছে। তার দেহ 'রাসায়নিক দিয়ে মমি' করা হয়েছিল। জনের মাথার খুলির আঘাতটি একটি নির্দিষ্ট বস্তুর সাথে মেলে। লেইয়ের বাগান থেকে আড়াই পাউন্ড ওজনের একটি পাথরের ব্যাঙ পাওয়া গিয়েছিল, যা চকলির বর্ণনার সাথে মিলে যায়। প্যাথলজিস্ট রিচার্ড জোনস তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, মাথার খুলিতে কয়েকটি ফ্র্যাকচার ছিল।

সাবিনের বন্ধুরা বলেছিলেন, তিনি মানুষের মনোযোগ তৈরি করতে পছন্দ করতেন। এ কারণেই তিনি জীবনে অনেক নাটক করেছেন। তার জীবনযাত্রার সঙ্গে মানানসই ছিল এই করুণ সমাপ্তি।

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন