পৃথিবীর দোজখ যে কারাগার
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮:০২, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত, নির্মম-নিষ্ঠুর ও বর্বর কারাগার হচ্ছে, এল সালভাদোরের টেকোলুকার সুপারম্যাক্স সেন্ট্রো ডি কনফিনামিয়েন্তো দেল টেরোরিজমো জেল। সংক্ষেপে এর নাম সিকোট জেল। এই জেলের কয়েদিরা থাকে মুরগির মতো খোপে।
তাদের ন্যূনতম যে মানবাধিকার পাওয়ার কথা, তারা তার তিল পরিমাণও পায় না। উপরন্তু প্রতি মুহূর্তে তাদের উপর চালানো হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন, যা শুনলে পাষাণের চোখেও পানি আসে। তাই এই জেলকে বলা হয় পৃথিবীর দোজখ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর নাম দিয়েছে, আধুনিক সভ্যতার ব্ল্যাক হোল।
ডেইলি মেইল সম্প্রতি কারাগারটি নিয়ে একটি সাড়া জাগানো রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটি প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ পড়ে গেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, কারাগারে অত্যাচারের মাত্রা এমন ভয়াবহ যে কয়েদিরা বাঁচতে চায় না। সারাক্ষণ তারা নিজেদের মৃত্যু কামনা করে। বিনে চিকিৎসা ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গত দুই বছরে ৩৬৩ জন কয়েদির মৃত্যু ঘটেছে।
ডেইলি মেইলের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কারাগারে কেউ একবার প্রবেশ করলে তাকে আর বাইরে বের হতে দেয়া হয় না, এমনকি কারাগারের ভেতরের খোলা জায়গায়ও না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সাড়ে তেইশ ঘণ্টাই তাদের রুমে আটকে রাখা হয়। এবং পায়ে শেকল পরে মাত্র ৩০ মিনিট কারাগারের করিডোরে হাটাহাটি ও ব্যায়াম করার সুযোগ পায় বন্দিরা।
কয়েদিদের শোবার জায়গা স্টিলের ফ্রেম দিয়ে তৈরি। প্রতিটি কক্ষে আছে আশিটি করে খোপ। এবং সেখানে আশিজন থাকার কথা থাকলেও গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হন দেড় থেকে দুইশ আসামি।
বন্দিদের ঘুমানোর স্টিলের সেই খোপে শোবার জন্য কোনো গদি বা তোসক নেই। তবে প্রত্যেক সেলে আছে দুটি টয়লেট এবং দুটি বেসিন। টয়লেটে সবসময় লাইন পড়ে। প্রায়ই অনেকের নষ্ট হয় কাপড়চোপড়।
সেলগুলোতে কোনো জানালা, এমনকি ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থাও নেই। তাই ভেতরে কোনো বাতাস ঢোকে না। দিনের বেলায় কক্ষের ভেতরে তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট, বা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। শরীর পোড়া তাপে কয়েদিরা মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করে। দিনটা কোনো মতে পার করলেও রাতে তারা চিৎকার করে কাঁদে।
ডেইলি মেইল জানায়, কয়েদিদের ঠিক মতো খেতেও দেয়া হয় না। এমনকি, পানি পানের জন্য একটা গ্লাস পর্যন্তও নেই। পশুর মতো প্লাস্টিকের ব্যারেল থেকে তারা পানি খায়।
এই জেলে একবার ঢুকলে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়া হয় না। জটিল অসুখেও তারা চিকিৎসা পায় না। রোগশোকে তারা ধূঁকেধূঁকে মারা যায়। এই অবস্থার মধ্যেও বন্দিরা শান্ত ও মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করে। যদিও পুনর্বাসন বা ভালো আচরণের সাথে সভ্য সমাজে তাদের ফিরে আসার কোনও আশা নেই।
কারাগার সম্পর্কে এপি'র পোর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, সমাজে ফিরে আসতে তাদের জন্য কোনও কর্মশালা, শিক্ষামূলক কর্মসূচী কিংবা প্রায়শ্চিত্তের কোনও সুযোগ নেই।
মানবাধিকার সংগঠনগুলি এই কারাগারকে অ্যাডলফ হিটলার এবং নাৎসিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করেছে।
বিচারের জন্য কয়েদিদের কখনো আদালতেও তোলা হয় না। বিচার চলে ভিডিও কনফারেন্সে। অর্থাৎ, বিচারক বন্দিদের সাথে শুনানি করেন ভিডিও কলের মাধ্যমে।
কারাগার পাহারা দেওয়ার জন্য আটশ পুলিশের একটি দাঙ্গাবাহিনী আছে। সশস্ত্র অবস্থায় তারা করিডোরগুলিতে টহল দেয়। বন্দিরা গোপনীয়তার অধিকার থেকেও সম্পূর্ণ বঞ্চিত। কারণ, সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে ২৪ ঘন্টা নজর রাখা হয় তাদের ওপর। এমনকি, বাথরুমেও লাগানো আছে সিসি ক্যামেরা।
বন্দিদের যখন কারাগারে আনা হয়, তখন সবার মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। অনেকে চুল ফেলতে চায় না, তখন কয়েকজন মিলে ধরে তাদের মারধর ও শারীরিক নির্যাতন করে কারারক্ষীরা। জোরজবরদস্তি করে ফেলে দেয়া হয় মাথার চুল। এরপর পরতে দেয়া হয় হাফ প্যান্ট। ন্যাড়া মাথায় লাইন ধরে মাথা নিচু করে সেলের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয় কয়েদিদের। সেলের ভেতর তারা হাফ প্যান্ট পরেই থাকে।
কারাগারটিতে ধারন ক্ষমতা ৪০ হাজার হলেও এখন আছে ২০ হাজার আসামি। ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে গেলে প্রত্যেক বন্দির ভাগে কক্ষের অংশ পড়বে তেইশ দশমিক ছয় দুই বর্গইঞ্চি।
বন্দিদের জন্য নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে, নির্যাতন ও প্রতিরোধ বিষয়ক জাতিসংঘের উপকমিটির প্রাক্তন সদস্য মিগুয়েল সার্রে এই কারাগারটিকে 'কংক্রিট ও ইস্পাতের তৈরি একটি খাঁচা' বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্ক।
১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এল সালভাদোরে গৃহযুদ্ধ বাধে। গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও তাতে জড়িত এমএস-১৩ এবং ব্যারিও-১৮ সন্ত্রাসী গ্রুপ সেদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা ২০২২ সালের ২৬ মার্চ ৬০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করে। এরপর সালভাদোরের রাষ্ট্রপতি নায়েব বুকেল একইবছর বারোশ পঞ্চাশ কোটি টাকা ব্যয়ে ল্যাটিন আমেরিকার বৃহত্তম এই কারাগারটি নির্মাণ করেন এবং এটি চালু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে।
কারাগার চালু হওয়ার পরের দিন, বুকেল ১৯২০-এর দশকে নাৎসি আইনবিদ কার্ল স্মিতের চিন্তাপ্রসূত 'ব্যতিক্রম রাষ্ট্র' ঘোষণা করেন। তারপর আদালতের আদেশ ছাড়াই সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আটক করতে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা প্রদান করেন। এরপর, রাজনৈতিক সমাবেশের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার মতো অধিকারও কেড়ে নেন।
'ব্যতিক্রম রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা হলে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত কোনো অধিকার যা জনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে কিছু নিশ্চিত প্রাপ্যঅধিকার সাময়িকভাবে স্থগিত করার অনুমতি দেয়।
এল সালভাদোরে এই নীতি ব্যবহারের ফলে হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে আটক করে পাঠানো হয় সিকোট কারাগারে। ভিন্নমতের মানুষকে নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে শত শত মৃত্যু, নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং রাষ্ট্রের 'অভ্যন্তরীন শত্রু' বলে বিবেচিত ব্যক্তিদের গুম করার পর তাদের সিকোট জেলে পাঠান নায়েব বুকেল।
মানবাধিকার সংগঠন সোকোরো জুরিডিকো হিউম্যানিটারিও ডেইলি মেইলকে জানিয়েছে, ব্যতিক্রম রাষ্ট্রের অধীনে আটককৃতদের এক-তৃতীয়াংশই নির্দোষ। প্রতিহিংসাবশত তাদের অন্যায়ভাবে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ১৬ মার্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে আমেরিকায় আশ্রয় নেয়া অভিবাসী ভেনেজুয়েলার এমএস-১৩ সন্ত্রাসী গ্রুপের ১৩জন রিং লিডারসহ ১০১জনকে পুলিশ দিয়ে আটক করেন। ধরার পর তাদের হাতে পায়ে শেকল পরিয়ে বিশেষ বিমানে করে সিকোট কারাগারে পাঠান। এই সন্ত্রাসীদের সিকোট কারাগারে বন্দি রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এল সালভাদোরকে পঁচাত্তর কোটি টাকা দেবে। এ নিয়ে দুদেশের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছে।
এই ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু ট্রাম্প এসবের তোয়াক্কাই করছেন না। তিনি বলেছেন, এই সন্ত্রাসীরা আমেরিকার মাটিতে বসে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুনখারাবি ও সন্ত্রাসীকর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলো। আমেরিকায় সন্ত্রাসীদের কোনো স্থান নেই।