সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫

| ৫ কার্তিক ১৪৩২

তিন দশক পরও যে সিনেমা মুগ্ধ করছে ভারতীয় দর্শককে

আন্তর্জাকি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩:৪৩, ২০ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৬:১১, ২০ অক্টোবর ২০২৫

তিন দশক পরও যে সিনেমা মুগ্ধ করছে ভারতীয় দর্শককে

ছবি: সংগৃহীত

মুম্বাইয়ের ঐতিহাসিক মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে আলো নিভতেই ম্যান্ডোলিনের প্রথম সুর বাজে। মুহূর্তেই দর্শকরা উঠে দাঁড়ায়—যেন তিন দশক ধরে চলতে থাকা এক ভালোবাসার আচার। আলোর বিপরীতে ভেসে ওঠে শাহরুখ খান আর কাজলের চেনা ছায়া। সামনের সারিতে এক নবদম্পতি দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় বন্দি করে নিচ্ছে নিজের জীবনের সেই চিরন্তন দৃশ্য—যে পর্দায় প্রেমকে অমর করেছে এক সিনেমা, দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে।

১৯৯৫ সালের ২০ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া ডিডিএলজে ছিল ভারতীয় সিনেমার এক যুগান্তকারী অধ্যায়। রাজ মালহোত্রা (শাহরুখ) আর সিমরন সিং (কাজল)—দুই ভারতীয় বংশোদ্ভূত লন্ডনবাসী তরুণ-তরুণীর প্রেমের গল্প, যারা ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে একে অপরকে খুঁজে পায় এবং পরে সেই প্রেমকে সামাজিক স্বীকৃতি পেতে লড়ে যায়। ছবিটি শুধু প্রেমের গল্প নয়—এটি নব্বইয়ের দশকের ভারতের মানসিক রূপান্তরের প্রতীক, যখন দেশটি সমাজতান্ত্রিক ঘেরাটোপ ভেঙে নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করছিল।

‘এক সিনেমা, এক প্রজন্মের আত্মপরিচয়’

চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়ার ভাষায়, “এই ছবির সাফল্যকে একক কোনো উপাদান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যখন সিনেমার দেবতারা চান, তখন নক্ষত্রগুলো একসঙ্গে সারিবদ্ধ হয়—এবং জন্ম নেয় এমন এক ক্লাসিক, যা পরবর্তী প্রজন্মের প্রেমের নকশা হয়ে ওঠে।”

আদিত্য চোপড়া, কিংবদন্তি পরিচালক যশ চোপড়ার পুত্র, মাত্র তেইশ বছর বয়সে লিখেছিলেন এই ছবির চিত্রনাট্য। তার প্রজন্মের ভাবনা ছিল উন্মুক্ত দিগন্তের—বিশ্বের দিকে তাকানো, কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে না যাওয়া। তাই ডিডিএলজে-র রাজ ও সিমরন পশ্চিমের মুক্ত চিন্তা ও ভারতের ঐতিহ্যের মিলনবিন্দু হয়ে ওঠে।

বিদ্রোহ নয়, অনুমতির মধ্যেই প্রেম

চলচ্চিত্রটির এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর সাংস্কৃতিক বার্তা। তখনকার বলিউডে প্রেম মানেই ছিল বিদ্রোহ—অভিভাবকের বিরুদ্ধে পালিয়ে বিয়ে। কিন্তু আদিত্য চোপড়া এই ধারণা বদলে দিলেন। রাজ প্রেমিকের ভূমিকায় এক ‘বিদ্রোহী-ভদ্রলোক’—যিনি সিমরনের বাবার অনুমতি নিয়েই তাকে জয় করতে চান। শেষ দৃশ্যে সিমরনের পিতা বলদেব সিংয়ের সংলাপ—“যা সিমরন, নিজের মতো করে বাঁচো; তোমার জীবন তোমার নিজের।” “जा सिमरन, जा, जी ले अपनी ज़िंदगी!”—হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে চিরঅমর হয়ে আছে।

এই পরিণতি ভারতীয় সমাজের গভীর মনস্তত্ত্বে নাড়া দিয়েছিল। কারণ এটি ছিল একসঙ্গে দুই প্রজন্মের পুনর্মিলন—পিতা-মাতা ও সন্তান, ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, ভারত ও প্রবাসের।

সংগীত, পোশাক ও স্বপ্নের মিশেল

জতিন-ললিতের সুরে তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম কিংবা মেহেন্দি লাগা কে রাখনা আজও প্রেমের প্রতীক। আর ডিজাইনার মণীশ মালহোত্রার হাতে কাজলের পোশাক হয়ে উঠেছিল এক সাংস্কৃতিক ক্যানভাস—লন্ডনের মেয়ে, কিন্তু পাঞ্জাবের প্রাণ। স্কার্টের সঙ্গে দোপাট্টা, পশ্চিমী ফ্যাশনের ভেতরে ভারতীয় কোমলতা।

ভারতীয় সিনেমায় নতুন যুগের সূচনা

ডিডিএলজে ছিল প্রথম বলিউড সিনেমা যেখানে প্রবাসী ভারতীয়দের জীবনের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব কেন্দ্রীয় থিমে এসেছে। এর আগে বিদেশের প্রেক্ষাপট মানে ছিল হয় নেতিবাচক চরিত্র নয়তো ‘অভিশপ্ত আধুনিকতা’। কিন্তু এখানে প্রবাস মানেই আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান।

এই সিনেমাই তৈরি করে দিয়েছিল বলিউডের পরবর্তী রোমান্স যুগের ব্লুপ্রিন্ট—পরদেশ (১৯৯৭), কাভি খুশি কাভি গম (২০০১) কিংবা কাল হো না হো (২০০৩)-এর মতো চলচ্চিত্রে সেই ছায়া স্পষ্ট। শাহরুখ-কাজলের জুটি হয়ে ওঠে ভারতীয় পর্দার সর্বাধিক স্মরণীয় প্রেমিকযুগল।

মারাঠা মন্দির: এক জীবন্ত জাদুঘর

তিন দশক পরও মুম্বাইয়ের মারাঠা মন্দিরে প্রতিদিনই চলে ডিডিএলজে। টিকিটের দাম মাত্র ৮০ রুপি। দর্শক এখনো হাসে, কাঁদে, মোবাইল তুলে ভিডিও করে। থিয়েটারের ম্যানেজার মনোজ পাণ্ডে বলেন, “২০১৫ সালে আমরা প্রদর্শন বন্ধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এত চিঠি ও প্রতিবাদ এল যে, আমাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো।”
আজও প্রতিদিন প্রায় একশো টিকিট বিক্রি হয়। ভেতরের পুরনো লাল আসন, সস্তা পপকর্ন আর সেই অমলিন সুর—সব মিলিয়ে যেন এক টাইম ক্যাপসুল।
সমালোচনার দিকও আছে।

তবে সময়ের বিচারে কিছু দৃশ্য আজকের দর্শকের কাছে অস্বস্তিকর। যেমন, মাতাল অবস্থায় সিমরনকে ভয় দেখিয়ে রাজের ‘মজা করা’ দৃশ্যটি আজ গ্যাসলাইটিং হিসেবে ধরা হয়। নারীর স্বপ্ন বা পেশাগত আকাঙ্ক্ষার অনুপস্থিতিও এখন প্রশ্নের মুখে। তবু অনুপমা চোপড়ার মতে, “প্রতিটি চলচ্চিত্র তার সময়ের সন্তান। তখন আমরা এসব প্রশ্ন তুলিনি—আমরা কেবল প্রেমে ভেসে গিয়েছিলাম।”

অমর প্রেম, অমর প্রতিশ্রুতি

আজও মারাঠা মন্দিরের শেষ সারিতে বসে সুনীল শেঠে নামের এক মধ্যবয়সী হিরে শ্রমিক চোখ ভিজিয়ে বলেন,“যতদিন বাঁচব, ততদিন এই সিনেমা দেখব। এটা শুধু একটা গল্প নয়—এটা আমার জীবনের একটা অংশ।”

মূল লেখা : বিবিসি

অনুবাদ : সমাজকাল

আরও পড়ুন