প্যারিসে ল্যুভর জাদুঘরে ডাকাতি
সাত মিনিটে উধাও ফরাসি রাজমুকুট ও গহনা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮:০৬, ২০ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১০:১৮, ২০ অক্টোবর ২০২৫

প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘর, যেখানে রয়েছে মোনালিসা থেকে শুরু করে শত শত বছরের রাজকীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন। রবিবার (১৯ অক্টোবর) সকালে সেই জাদুঘরে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লরঁ নুনিয়েজ নিশ্চিত করেছেন, মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে “অমূল্য” রাজকীয় গহনা চুরি করে পালিয়েছে একদল পেশাদার চোর।
রবিবার সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে ল্যুভরের অ্যাপোলো গ্যালারিতে ঘটে এই ঘটনা। সেখানেই সংরক্ষিত রয়েছে ফরাসি রাজপরিবারের মুকুট ও রত্নসম্ভার, যার মধ্যে ছিল লুই চতুর্দশের হার্ডস্টোন ভেসেল কালেকশন এবং নেপোলিয়নের আমলের জহরত।
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নুনিয়েজ রেডিও ফ্রান্স ইন্টারকে জানান, “একদল দুষ্কৃতকারী বাইরের দিক থেকে একটি পণ্যবাহী লিফট ব্যবহার করে জাদুঘরে প্রবেশ করে। তারা জানালা কেটে ভিতরে ঢোকে এবং দুইটি বাক্স ভেঙে ফেলে।”
ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী চোরেরা মোট নয়টি ঐতিহাসিক গহনার মধ্যে আটটি নিয়ে পালিয়েছে।
চুরি যাওয়া গহনার মধ্যে ছিল:
- রানি মেরি-অ্যামেলি ও রানি হরতোঁসের নীলা কানের দুল ও টায়রা,
- এমপ্রেস মেরি-লুইজের পান্না মালা ও দুল,
- এমপ্রেস ইউজেনির “রিলিকুয়ারি ব্রোচ” ও বৃহৎ করসাজ বো ব্রোচ,একক নীলা কানের দুল আর সবচেয়ে মূল্যবান— রানি ইউজেনির রাজমুকুট, যাতে বসানো আছে ১,৩৫৪টি হীরা ও ৫৬টি পান্না।
চোরেরা পালানোর সময় তাড়াহুড়োয় এই মুকুটটি ফেলে যায় বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর লর বেক্যু। তবে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
ভাঙ্গা জানালা, ত্যাগ করা যন্ত্রপাতি ও মোটরসাইকেল পালানো দল
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছে দুটি ছোট চেইনসো, একটি ব্লোটর্চ, গ্লাভস, ওয়াকি-টকি, গ্যাসোলিনের বোতল, একটি কম্বল ও সেই ক্ষতিগ্রস্ত রাজমুকুট।
ল্যুভরের এক নিরাপত্তারক্ষী ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, ফলে ডাকাতরা দ্রুত মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়।
পুলিশ জানিয়েছে, অন্তত চারজন ব্যক্তি এ ঘটনায় জড়িত ছিল এবং তারা অস্ত্রহীন থাকলেও নিরাপত্তারক্ষীদের চেইনসো দেখিয়ে ভয় দেখায়।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন,“ল্যুভরে সংঘটিত এই চুরি আমাদের ইতিহাসের প্রতি আঘাত। চোরদের খুঁজে বের করা হবে এবং নিদর্শনগুলো ফিরিয়ে আনা হবে।”
সংস্কৃতি মন্ত্রী রাশিদা দাতি ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, জাদুঘর খোলার সময়ই হামলাটি হয় এবং সৌভাগ্যবশত কেউ আহত হয়নি।
এক পর্যটক গাইড রায়ান এল মানদারি বলেন,“আমি অ্যাপোলো রুমে পর্যটকদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ জানালার দিক থেকে জোরে শব্দ আসে—ধাপ ধাপ করে কিছু পড়ার মতো আওয়াজ। তারপরই নিরাপত্তারক্ষীরা চিৎকার করে বলেন, ‘বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান!’”
তিনি জানান, তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি যে এটি একটি ডাকাতি, কেবল আতঙ্কে পর্যটকদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
প্যারিস প্রসিকিউটর বেক্যু জানিয়েছেন, তদন্তে বিদেশি সংযোগ বা আন্তঃদেশীয় অপরাধচক্রের সংশ্লিষ্টতা নাকচ করা যাচ্ছে না। মামলাটি বর্তমানে “সংগঠিত অপরাধচক্রের মাধ্যমে সংঘটিত চুরি ও ষড়যন্ত্র” হিসেবে তদন্তাধীন।
এদিকে পুলিশ “অভিজ্ঞ ও দক্ষ পেশাদার” দল হিসেবে সন্দেহ করছে যাদের আগে থেকেই ল্যুভরের কাঠামো সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা ছিল।
প্যারিস সেন্টারের মেয়র আরিয়েল ওয়েইল সাংবাদিকদের বলেন,এক শতাব্দীরও বেশি সময় পর ল্যুভর আবার এমন চুরির শিকার হলো। শেষবার এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৯১১ সালে, যখন মোনা লিসা চুরি হয়েছিল।
২০২৪ সালে ল্যুভর জাদুঘর ৮.৭ মিলিয়ন দর্শনার্থী গিয়েছিল—বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনায় এমন ডাকাতি ফ্রান্সের জন্য এক বড় সাংস্কৃতিক ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আর্ট রিকভারি ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টোফার মারিনেলো বলেছেন,“যদি চোরেরা কেবল অর্থের লোভে থাকে, তারা এই গহনাগুলো গলিয়ে ফেলবে বা পাথর কেটে নতুন আকারে বিক্রি করবে। তখন এগুলো আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্রুত সমন্বয় না হলে “আমরা ইতিহাস হারাতে থাকব”।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ল্যুভর আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে তদন্তের স্বার্থে। ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ফুটেজ ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ চলছে।
তদন্ত কর্মকর্তারা আশা করছেন, চোরদের ফেলে যাওয়া যন্ত্রপাতি ও পোশাক থেকে শিগগিরই গুরুত্বপূর্ণ ক্লু পাওয়া যাবে।
এই সাত মিনিটের “ল্যুভর ডাকাতি” কেবল একটি অপরাধ নয়—এটি ইউরোপের সাংস্কৃতিক গর্বের ওপর আঘাত।
ফরাসি রাজমুকুটের প্রতীক হয়ে থাকা এই নিদর্শনগুলো শুধু হীরার মূল্যেই নয়, ইতিহাসের গভীর স্মৃতিতে অমূল্য। ফরাসি কর্তৃপক্ষ এখন একটাই লক্ষ্য সামনে রেখেছে—চোরদের ধরা এবং ঐতিহ্যের প্রতীক গহনাগুলোকে ফেরত আনা।