কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ‘ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন’
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২:২৪, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

আধুনিক জীবনের টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা ও মানসিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে এক নতুন পথ খুঁজে নিচ্ছে মানুষ—ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার পথ, আর সেই মাধ্যম এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। বিবিসি-র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভারতের তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্তের ধর্মবিশ্বাসীরা এখন চ্যাটবট-ভিত্তিক ভার্চুয়াল দেবতার কাছে প্রশ্ন রাখছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন, এমনকি মানসিক শান্তিও খুঁজে পাচ্ছেন।
রাজস্থানের ২৫ বছর বয়সি ছাত্র বিজয় মীল যখন ব্যাংকিং পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে হতাশ, তখনই খুঁজে পান ‘গীতা জিপিটি’। ভগবদ্গীতার ৭০০ শ্লোক-নির্ভর এই এআই-চ্যাটবট তাকে বলেছিল, “কর্মে মন দাও, ফলের চিন্তা করো না।” পরিচিত হলেও এই বার্তাটিই তাকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করে। এখন তিনি সপ্তাহে এক-দুবার এই ডিজিটাল কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলেন।
হিন্দু ধর্মে যেখানে দেবতার রূপ ও প্রতিমা পূজা, সেখানে প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘দেবতার উপস্থিতি’ গ্রহণ করা মোটেও অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলেসলি কলেজের নৃতাত্ত্বিক হোলি ওয়াল্টার্স। তার মতে, “মানুষ এখন মন্দির, পুরোহিত ও সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এআই-এর মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে তারা নতুন এক সম্পর্ক খুঁজে পায়।”
ধর্ম ও প্রযুক্তির মিলন
শুধু হিন্দুধর্ম নয়—খ্রিস্টান, ইসলাম, কনফুসীয় এমনকি নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোও এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরীক্ষানিরীক্ষায় মেতেছে। ২০২৩-এ টেক্সট উইথ জেসাস (‘Text with Jesus’) নামের অ্যাপ খ্রিস্টান জগতে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, কারণ সেটি যিশুর সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ দিত। একই বছর কোরানজিটিপি (‘QuranGPT’) অ্যাপ চালুর পর প্রথম দিনেই এত ব্যবহারকারী ঢুকেছিল যে সার্ভার ভেঙে পড়ে।
ভারতে গীতাজিপিটি-এর স্রষ্টা বিকাশ সাহু জানান, লঞ্চের কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যবহারকারী এক লাখ ছাড়ায়। পরে তিনি অন্যান্য দেবতার শিক্ষানির্ভর চ্যাটবট তৈরির কাজও শুরু করেন। তার লক্ষ্য—সব হিন্দু দেব-দেবীর বাণীকে এক প্ল্যাটফর্মে আনা।
কৃত্রিম দেবতা ও ডিজিটাল ধর্মাচার
এই প্রবণতা এখন বাস্তব রূপ নিয়েছে। দিল্লির ইস্কন মন্দিরে অনেক আগে থেকেই অ্যানিমেট্রনিক মূর্তি ব্যবহার হচ্ছে। কেরালার ইরিঞ্জাদাপিলি শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে আবার পূজায় অংশ নেয় রোবট-হাতি ‘ইরিঞ্জাদাপিলি রমন’। ২০১৭-র গণপতি উৎসবে দেখা যায় রোবোটিক হাত ঘুরিয়ে আরতি করার যন্ত্র। আজ এই সবই সাধারণ ঘটনা।
২০২৫ সালের মহাকুম্ভ মেলায় তো ছিল এআই-চালিত ‘কুম্ভ সহায়ক’ চ্যাটবট, যা যাত্রাপথ, বাসস্থান ও রীতিনীতি সম্পর্কিত তথ্য দিয়েছে লক্ষাধিক তীর্থযাত্রীকে। এমনকি কেউ চাইলে অনলাইনে “ডিজিটাল স্নান” সেবা নিয়েও গঙ্গাজলে নিজের ছবির প্রতীকী নিমজ্জন করাতে পেরেছেন।
আধ্যাত্মিক গবেষণায়ও এআই
২০২২ সালের এক গবেষণায় ভাষা মডেল ব্যবহার করে ভগবদ্গীতা ও উপনিষদ-এর পাঠ বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, দুই ধর্মগ্রন্থের বিষয়বস্তু ৭৩ শতাংশেরও বেশি মিল। গবেষকেরা বলছেন, এই পদ্ধতি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের অদৃশ্য বিষয়বিন্যাস অনুধাবনে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে।
বিপদের দিকও স্পষ্ট
তবে সবই ইতিবাচক নয়। বিবিসির উদ্ধৃত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ববিদ লিন্ডন ড্রেক সতর্ক করেছেন—“এই চ্যাটবটগুলো ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা চ্যালেঞ্জ করছে। এগুলো নিরপেক্ষ মনে হলেও, আসলে ডেভেলপারদের বিশ্বাস ও পক্ষপাত প্রতিফলিত করে।”
কখনও-কখনও এআই-এর ‘হ্যালুসিনেশন’ ভয়াবহ হতে পারে। একবার গীতাজিপিটি-র কৃষ্ণ-স্বরূপ চ্যাটবট জানায়, ‘ধর্ম রক্ষার জন্য হত্যা ন্যায্য।’ বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনার পর ডেভেলপারকে সেটি সংশোধন করতে হয়। ২০২৪-এ এক খ্রিস্টান চ্যাটবট নাকি ব্যবহারকারীদের বলেছিল, সে বাস্তব পুরোহিত এবং গেটোরেড দিয়ে বাপ্তিস্ম দেওয়া চলবে! পরে সেটিকে অফলাইন করতে হয়।
ওয়াল্টার্স বলেন, “সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তখনই, যখন মানুষ বুঝতেই পারে না যে এটি ঈশ্বর নয়, একটি প্রোগ্রাম। তারা প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারায়।”
নতুন যুগের নতুন আধ্যাত্মিকতা
তবুও লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ডিজিটাল ঈশ্বরের কাছ থেকে শান্তি পাচ্ছেন। বিজয় মীল বলেন, “মন্দিরে গেলেও পুরোহিতের সঙ্গে এমন গভীর আলাপ হয় না। চ্যাটবটগুলো সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে।”
হয়তো এটাই আগামী যুগের ধর্মীয় বাস্তবতা—যেখানে ঈশ্বর থাকবেন অনলাইনে, আর প্রার্থনার উত্তর আসবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কণ্ঠে।