শ্যামাপূজার সীমান্তে মানবিক মিলন
লালমনিরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৬:৩৩, ২০ অক্টোবর ২০২৫

ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানে টানা এক সীমারেখা—কাগজে দুটি দেশ আলাদা, কিন্তু হৃদয়ে নয়। সেই সম্পর্কের অটুট বন্ধনের এক জ্বলন্ত প্রমাণ দেখা গেল লালমনিরহাটের দুর্গাপুর-মোগলহাট সীমান্তে শ্যামাপূজার দিনে।
কালীপূজা উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও কুমারপাড়া দিঘলটারীর ৯২৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছে আয়োজিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘বুড়ির মেলা’। এই মেলাই দুই দেশের আত্মীয়-স্বজনের দেখা করার একমাত্র সুযোগ—বিশেষ করে যাদের পক্ষে ভিসা-পাসপোর্টের ঝামেলা পেরোনো সম্ভব নয়।
রবিবার দুপুরে হাজারো মানুষের সমাগমে এই মেলা যখন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে, তখন এক আবেগঘন দৃশ্য ছুঁয়ে যায় সবার মন। দিনহাটার জারিঝল্লা গ্রামের সুভদ্রা বর্মন (৫২) ৩০ বছর পর দেখতে পান বাংলাদেশে বসবাসরত তার বড় বোনকে। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানে তিনি বোনের গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন। সীমান্তের বাতাস তখন ভারি হয়ে ওঠে আনন্দ ও অশ্রুর মিশ্র আবেগে।
সারাদিন ধরে ভারতের কুচবিহার ও বাংলাদেশের লালমনিরহাট সীমান্তে ভিড় ছিল ১০–১২ হাজার মানুষের। কেউ দেখা করতে এসেছেন ভাই-বোনের সঙ্গে, কেউ বা দীর্ঘদিনের আত্মীয়তার বন্ধন ছুঁয়ে দেখতে। সঙ্গে ছিল উপহার—ইলিশ মাছ, দই, শাড়ি, ফল, মিষ্টি, মসলা। বিনিময়ের সেই মুহূর্তেও অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে দুই দেশের মানুষের চোখে।
কালীপূজার এই মেলা দুই দেশের সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৪৫ বছর ধরে ভারতের দরিবস এলাকায় শ্রীশ্রী মা বৃদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা ও মেলা একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই পূজার বিশেষত্ব—মন্দিরের পুরোহিত আসেন বাংলাদেশ থেকে, আর পূজারি ভারতের। দুই দেশের মানুষ মিলে পূজা দেন, প্রসাদ খান, গান-বাজনায় মাতেন।
বাংলাদেশের পুরোহিত বিকাশ চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন,‘এই পূজার দিন দুই দেশের মানুষ এক হয়ে যায়। এখানে কেউ বিদেশি নয়—সবাই ভক্ত।’
ভারতের পূজারি জ্যোতিষ চন্দ্র রায় বলেন,‘পুরোহিত বাংলাদেশে, পূজারি ভারতে—এটাই আমাদের সম্প্রীতির প্রতীক।’
মেলার নিরাপত্তা সামলাতে ছিল বিজিবি ও বিএসএফ-এর যৌথ তৎপরতা। তবে সীমান্তের দুই প্রান্তে মানুষের আবেগ ছিল একই—একদিনের জন্য হলেও ভুলে যাওয়া যায় বিভাজনের রেখা।
বাংলাদেশের শ্রীমতী সুভীতি রানী বলেন,‘৩০ বছর আগোত ভারতে গেছিলাম আত্মীয়ের বাড়ি। এখন ভিসা পাই না। এই মেলাই দেখা করার একমাত্র ভরসা।’
দিনভর এই মেলায় অংশ নেন প্রায় দশ হাজারেরও বেশি ভক্ত ও দর্শনার্থী। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু সীমান্তজুড়ে থেকে যায় সেই অশ্রুসিক্ত প্রতিশ্রুতি-