পর্ব-২
এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি
প্রকাশ: ০৩:৩০, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
মো. সিরাজুল ইসলাম খন্দকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা। গ্রাফিকস: সমাজকাল
ফিরে দেখা: ১৮ মার্চ ১৯৭১
সত্তরে মেট্রিক পাস করে অর্থাভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছিলাম। এমন সময়ে আমাদের বাড়িতে ফুলঘর নামক প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলো। এক ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করলে আমার বিএ পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ ওরা বহন করবে এবং আমার ছোট বোনের বিয়ের খরচও ওরা দিবে। প্রস্তাবটা আসার পর আম্মা আমাকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেন এবং তাতে ব্যর্থ হয়ে এমন একজনকে ধরলেন যাকে আমি ভীষণ সমীহ করি। তিনি আমার সম্পর্কে বড় বোন, আম্বিয়া আপা। যার স্থান আমার কাছে মায়ের মতোই। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আমি আপার কথা চুপচাপ শুনে ঘরে এসে ভাবতে শুরু করি, কী করা যায়!
অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাড়ি ছেড়ে পালাব।
অতঃপর একদিন কপর্দকশূন্য আমি বিনা টিকিটে ট্রেনে চেপে টঙ্গীতে আমার এক ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় পালিয়ে এলাম। উনারা দুই ভাই মোহাম্মদ হাসিবউল্লাহ ও মোহাম্মদ মসিবউল্লাহ এবং এক ভাবি একই বাসায় থাকতেন। ভাবি আমাকে খুব আদর যত্ন করতেন। মোটামুটি ভালোই কাটছিল দিনগুলো।
তখন দেশের রাজনীতি ছিল তপ্ত। টঙ্গী শিল্পাঞ্চল এলাকা। প্রায়ই ছাত্র-শ্রমিক-জনতার পাকিস্তানবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল। আমিও সেই মিছিলে একাত্ম হয়ে মিশে যেতাম।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মওলানা ভাসানী ও ছাত্রনেতা, যারা চার খলিফা নামে তখন পরিচিত, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আ স ম আবদুর রবের তৎপরতায় সমগ্র দেশ যেন আন্দোলনে মুখর হয়ে উঠেছিল। ওই সময়টাতে খেয়েদেয়ে রেডিওতে খবর শুনে ও পত্রিকা পড়ে রোমাঞ্চিত হতাম।
২৩ মার্চ, ১৯৭১
দেশের অবস্থা ক্রমশ জটিল ও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। টঙ্গীতে শিল্পকারখানা বন্ধ হতে থাকে। শ্রমিকরা টঙ্গী ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সমগ্র টঙ্গী শহরজুড়ে অস্থিরতা বিরাজমান।
২৫ মার্চ, ১৯৭১
টঙ্গী শহরে সকাল থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কোথাও কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই। তবে তাতে বোঝার উপায় নেই যে, আজ রাতেই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক জঘন্যতম ঘটনা ঘটতে চলেছে। একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যদিয়ে দিনটা অতিবাহিত হলো।
রাতে যথারীতি শুয়ে পড়েছিলাম।
গভীর রাতে হঠাৎ করে মাইকের গগনবিদারী আওয়াজে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে জেগে উঠলাম।
মাইকে বলা হচ্ছিল: ‘ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ লাইনে ইপিআর-এর সাথে গোলাগুলি চলছে। ঢাকা শহরে মানুষকে গুলি করে মারা হচ্ছে ...।’
আমি ও মসিব ভাই ভয়ার্তভাবে ঘর ছেড়ে প্রধান সড়কে উঠলাম। দেখলাম, সড়কে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে। কারোর মুখে ‘টুঁ’ শব্দ নেই। তখন উত্তরা শহর বলতে কিছু ছিল না। মহাখালী পর্যন্ত প্রায় ফাঁকা ছিল। তাই, রাতের ঢাকায় গোলাগুলি ও মর্টারের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আকাশে লাল-নীল আলোকরশ্মি দেখতে পাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ ভয়ার্ত চিত্তে এসব দেখে ফের ঘরে ফিরে গেলাম। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।
২৬ মার্চ, ১৯৭১
এদিন ঘুম থেকে একটু দেরিতে জেগেছিলাম। ততক্ষণে ফুফাতো ভাইয়েরা ফ্যাক্টরিতে চলে গেছেন। ভাবি নাস্তা দিলেন। একটু পরে দেখি দুই ভাই চলে এসেছেন। ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমি ও হাসিবউল্লাহ ভাই হাঁটতে হাঁটতে তুরাগ নদীর পাড়ে এসে বসি। আমাদের মতো শত শত লোক সেখানে। দেখলাম, ক্লান্ত-শ্রান্ত-হতাশ ও ভীত-সন্ত্রস্ত আবালবৃদ্ধবনিতা দলে দলে ঢাকা থেকে হেঁটে এদিকেই আসছে। তাদের চোখেমুখে মৃত্যুভীতি বিরাজ করছে। পরিবহনের জন্য কোন যানবাহন সড়কে নেই। ক্লান্ত ও সর্বহারা মানুষগুলো একটু বিশ্রাম করেই নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে অজানায় পাড়ি দিচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে একসময় নিজেই ভয়ে কুঁকড়ে যাই এবং দুরুদুরু বক্ষে ঘরে ফিরে আসি।
বিকেলে ফের তুরাগ নদীর পাড়ে এসে দেখি লোকজন বিদ্যুতের খুঁটি ও নানা কিছু দিয়ে ব্রিজের উপর, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমিও একাজে তাদের সাথে হাত লাগালাম।
তার একটু পরই ঠাসঠাস করে দুটি জোরালো আওয়াজ শোনা গেল। সবাই তখন দৌড়ে পালাতে লাগল। অল্প পরে আবারও ঠা ঠা করে মেশিনগানের কর্কশ আওয়াজ। পড়িমরি করে দুই ভাই উত্তর দিকে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। পেছনে অবিরাম গুলি চলছে। জানতাম, রাইফেলের গুলির রেঞ্জ এক মাইল অব্দি যায়। আমরা তার আওতায়। তাই বেশি গুলি চলার সময় শুয়ে পড়তাম। পরে, শুনেছি পাকিস্তানি বাহিনীর সেই গুলিতে তুরাগের তীরে বহু মানুষ মারা গেছে।
দৌড়াতে গিয়ে একসময় আমি ও ফুফাতো ভাই একে অপরকে হারিয়ে ফেলি। অবিরাম ছুটতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে একস্থানে বসে যাই। অচেনা জায়গায় কি করব, কোথায় যাব। ভাবতে থাকি, আমার গন্তব্য কোথায়?
হাজার হাজার মানুষ পিঁপড়ের মতো টঙ্গী ছাড়ছে।
আমিও ওই দলের সঙ্গে হাঁটছি তো হাঁটছি...! একসময় পূবাইল রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছি। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঘোড়াশাল পৌঁছালাম। সামনে নদী। সবাই মিলে একটা নৌকায় চেপে নদী পার হয়ে রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে শুয়ে পড়ি। আমার পকেটে কোন টাকাপয়সা নেই। আকাশ পানে তাকিয়ে থাকি এবং ক্ষুধা নিয়েই ঘুমিয়ে যাই।
>>> চলবে
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা
