হাজারো অ্যাসিড আক্রান্ত নারীর কণ্ঠস্বর র্যাম্প মডেল রেশমা কুরেশি
রাজীব শাঁখারী
প্রকাশ: ২১:১৯, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
হাজারো অ্যাসিড আক্রান্ত নারীর কণ্ঠস্বর র্যাম্প মডেল রেশমা কুরেশি। ছবি: সংগৃহীত
সময়টা ছিল ২০১৪ সালের ১৯ মে। ১৭ বছরের এক ফুটফুটে কিশোরীর নাম রেশমা কুরেশি। মুম্বাইয়ের ট্যাক্সি চালকের ছোট মেয়ে কুরেশি। ছোটবেলা থেকেই বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। ঐদিন তিনি আলিম পরীক্ষা দিতে এলাহাবাদে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল তার বড় বোন গুলশন।
ট্রেনের কামরায় বসে রেশমা যখন বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে পড়ছিলেন, তখনই স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে মিশে ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন। তার দুলাভাই দলবল নিয়ে অ্যাসিডের বোতল হাতে অপেক্ষা করছিল।
টার্গেট রেশমার দিদি গুলশন। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে তারা গুলিয়ে ফেলে দুইবোনের মধ্যে। ভুল করে রেশমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা।

রেশমার মুখের ওপর তারা ছুঁড়ে মারে হলো গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিড। মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল রেশমার কোমল ফর্সা চামড়া, গলে গেল একটি চোখ। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্ল্যাটফর্মে লুটিয়ে পড়লেন রেশমা। তখন তার জীবনটাই যেন অন্ধকারে শেষ হয়ে গেল। এক পলকে চুরমার হয়ে গেল তার সব স্বপ্ন।
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর রেশমা আয়নায় নিজেকে দেখে চিৎকার করে ওঠে। অ্যাসিডে ঝলসানো মুখ দেখে চিনতে পারেননি নিজেকে। তার সুন্দর মুখটা হয়ে গিয়েছিল বীভৎস গলিত এক মাংসপিণ্ড। এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, অন্য চোখ দিয়েও ঝাপসা দেখছেন। তার মনে হয়েছিল, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন অনেক বার।

কিন্তু রেশমাতো হার মানার মেয়ে নন। তিনি ঠিক করলেন, যে সমাজ তাকে ‘কুৎসিত’ বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, সেই সমাজকেই তিনি দেখিয়ে দেবেন আসল সৌন্দর্য্য কী। তিনি যোগ দিলেন 'মেক লাভ নট স্কার্স' নামে এক এনজিও-তে। শুরু করলেন এক নতুন ধারার লড়াই।
ইউটিউবে বিউটি টিউটোরিয়াল বা মেকআপ ভিডিও বানাতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু তার ভিডিওগুলো ছিল সাধারণ মেকআপ ভিডিওর থেকে ভিন্ন। তিনি লিপস্টিক বা আইলাইনার লাগাতে লাগাতে বলতেন, "লিপস্টিক যেমন সহজে পাওয়া যায়, অ্যাসিডও বাজারে তেমনই সহজে পাওয়া যায়। দয়া করে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ করুন।"
তার এই ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসির মতো স্বনামধন্য গণমাধ্যমগুলো সকলেই রেশমার সাহসিকতার গল্প তুলে ধরল। এর ফলে ২০১৬ সালে ঘটল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইক-এ আমন্ত্রণ পেলেন রেশমা। আমন্ত্রণ পত্রে রেশমাকে ‘স্পেশাল র্যাম্প মডেল’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়।

একদিন যে মেয়েটিকে সবাই বলেছিল মুখ ঢেকে রাখতে, সেদিন সেই মেয়েটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন শো-এর র্যাম্পে হাঁটলেন ‘স্পেশাল র্যাম্প মডেল’ হিসেবে। পরনে ক্রিম রঙের গাউন, মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। তিনি প্রমাণ করলেন, সৌন্দর্য চামড়ায় নয়, থাকে সাহসে।
রেশমা কুরেশি আজ শুধু একজন মডেল নন, তিনি হাজারো অ্যাসিড আক্রান্ত নারীর কণ্ঠস্বর। তিনি আজ আর আয়নায় নিজেকে দেখে ভয় পান না। তিনি বলেন, "আমার মুখ নষ্ট হয়েছে, কিন্তু আমার স্বপ্ন নয়।" তার লড়াই আজও চলছে, অ্যাসিড বিক্রি বন্ধের দাবিতে, অ্যাসিড আক্রান্তদের অধিকার আদায়ের জন্য।
