রাষ্ট্রক্ষমতার ন্যায্য হিস্যা নেওয়ার কোনো চেষ্টাই দেশের বিপ্লবী বামরা নেয়নি
প্রকাশ: ২৩:০১, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
আরিফ জেবতিক
একজন বাম ছাত্রনেতা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের বামপন্থিদের মানুষ আসলেও মাফ করবে না।...আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, আনু মুহাম্মদ ও বদরুদ্দীন উমর। এই চারজনের তিনজন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় জীবিত ছিলেন, এবং একজনও বলেন নাই, ইউনূসরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বানানো একটা মেগা ডিজ্যাস্টার হইতে যাচ্ছে। আনু স্যাররে আলাদাভাবে দোষ দিচ্ছি এমন না। এই দায় আসলে আমাদেরও।’ আমি মাঝখানের কিছু বাদ দিয়ে কোট করেছি, আপনারা নিজ দায়িত্বে আসল লেখা খুঁজে পড়ে নিয়েন।
বাংলাদেশের মানুষ বামপন্থিদের মাফ করবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমার ধারণা মাফ করার মতো যথেষ্ট বামপন্থি এই দেশে টিকে থাকবে না। পৃথিবীর সভ্যতার বয়স এত হাজার বছর পেরিয়ে গেছে যে, এখানে আসলে মৌলিক কিছু ঘটার অবকাশ আর নেই, যাই ঘটে তা ইতোমধ্যে অন্য কোনো ফর্মে অন্য কোনো দেশে আগেই ঘটে গেছে।
সে হিসেবে আমরা ইরান কিংবা আফগানিস্তানের মতো ট্রান্সফর্মেশনের খুব কাছাকাছি আছি। ইরানে শাহকে দেশত্যাগে বাধ্য করা শক্তি ছিল দুইটি। একটি হচ্ছে উগ্র ডানপন্থি গ্রুপ, আরেকটি হচ্ছে বাম গ্রুপ। বামদের মূল শক্তি ছিল তিনটি। তুদেহ পার্টি, ফেদাহইন ই খালক এবং মুজাহিদ ই খালক। আসুন স্টেপগুলো খেয়াল করি।
১. শাহবিরোধী বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণি, ছাত্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্তকরণে এই বামদের শক্তিশালী ভূমিকা ছিল। উগ্র ডানপন্থিদের আসলে শরীরের শক্তি থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তিক, মেধাভিত্তিক সমস্ত শক্তির জোগান দিয়েছে বামরা। বুদ্ধিজীবীদের রাস্তায় নামিয়েছে বামরা।
২. তারপর রেজা শাহ পাহলভী ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।
৩. রেজা শাহের দেশত্যাগের পর ১ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরেন ত্রাতা, সকলের সম্মানিত ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি। নানান ঘটনার পরে সেনাবাহিনীর সমর্থনে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হন ১১ ফেব্রুয়ারি।
৪. তারপর শুরু হয় সংবিধান সংশোধন। সুন্দর করে সংবিধান সংশোধন হয়, তারপর শুরু হয় গণভোট, গণভোট করে চিৎকার।
৫. নতুন সংবিধানের আলোকে গণভোট হয় ডিসেম্বর মাসে। সেখানে আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে সুপ্রিম লিডার হিসেবে গণভোটে ডিক্লেয়ার করা হয়।
৬. ওহ, বামদের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বামরা শুরু করল তেল-গ্যাস-বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষা আন্দোলন, মানে ইরানি স্টাইল আর কী। তেল শ্রমিকদের নিয়ে ধর্মঘট, কারখানার শ্রমিকদের অর্গানাইজ করা ইত্যাদি।
৭. ইসলামী বিপ্লবীরা চরমভাবে মোকাবিলা করল বামদেরকে। ডান বিপ্লবীরা খুব সিস্টেমেটিকলি বামদের ইনফ্লুয়েন্স, বিশ্বাসযোগ্যতা, ইন্টেলেকচুয়াল পাওয়ারকে প্রথমেই টার্গেট করে নিউট্রালাইজ করল।
৮. তারপর রাস্তায় পেটান শুরু হলো। প্রথমে হালকা পাতলা মাইর।
৯ এই স্টেপে এসে বামরা দলে দলে অ্যারেস্ট হলো, নির্যাতিত হলো, জেলে গেল, খুন হলো। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে নিষিদ্ধ করা হলো। এভাবেই ইরানে বিপ্লব সম্পন্ন হলো। এখন সেদেশে কেউ বাম রাজনীতি করে কী না, করার সুযোগ আছে কী না জানি না।
এখন আমাকে বলেন, বাংলাদেশে এই ৯ স্টেপের কততম স্টেপে আছি আমরা এখন?
ফ্রান্স থেকে যেমন ইরানে গিয়েছিলেন খোমেনি, আমাদের ত্রাতাও এসেছিলেন ফ্রান্স থেকে।
৫ আগস্টের পরবর্তী ধারাবাহিকতা দেখলে দেখা যাবে যে, রাষ্ট্রক্ষমতার ন্যায্য হিস্যা নেওয়ার কোনো চেষ্টাই বাংলাদেশের বিপ্লবী বামরা নেয়নি, বরং প্রবল আগ্রহে ফরাসি দেশ ফেরত ত্রাতার পাছা চুম্বনে লিপ্ত হয়েছে। সেই সময় কিছু কিছু বাম দুর্যোগ মন্ত্রণালয় আর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের টাকাপয়সা দিয়ে দুয়েকটা সেমিনার কী অনুষ্ঠান কী উত্তরবঙ্গের গ্রামে কৃষক খাওয়ানোর নামে ধান্দাপাতি করে কিঞ্চিত টেকাটুকা কামিয়েছে। সেটা করতে গিয়ে নিজেদের সামাজিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে একেবারেই বাজারে তুলে দিয়েছে। আনু মোহাম্মদ শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান করেছেন (দুষ্ট লোকেরা বলে সেই অনুষ্ঠানেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের টাকা আছে, আমি সত্য-মিথ্যা জানি না, মিথ্যা হলে আয়োজকরা দয়া করে কেউ শুধরে দিয়েন) সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সব আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গ্রাফিতি আর পোস্টার প্রদর্শন করলেও ২০১৩ সালের শাহবাগের গণজাগরণকে মুছে ফেলেছেন। জামাতি প্রভুদের খুশি করতে তাদের এতই উচাটন আগ্রহ ছিল। আফসোসের বিষয় হচ্ছে, এই টাইপ বামরা সবাই মিলে ৮ মাসে যা কামিয়েছে, সমন্বয়করা একেকজন রোজ ৮ ঘণ্টা কাজ করে, এর চেয়ে বেশি কামিয়ে নিয়েছে।
বাম ছাত্রনেতার এই আত্মোপলব্ধিটা ভালো। হয়তো শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। হয়তো তুদেহ পার্টির মতো নির্মম পরিণামটা বাংলাদেশের বামদের ভাগ্যে ঘটবে না। তবে সেজন্য এসব বন্দর বরাদ্দ নিয়ে তাদের চুপচাপ থাকতে হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
* মতামত লেখকের নিজস্ব
