গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধীদের আমরণ অনশন: রাষ্ট্রের দায়-নীরবতা ও বিজয়ের অঙ্গীকার
প্রকাশ: ২১:১৭, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
মোহাম্মদ সোহেল রানা
একজন সচেতন নাগরিক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন প্রতিনিধি হিসেবে আমি তীব্র ক্ষোভ, হতাশা ও দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে লিখছি। গত ১৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া আমাদের গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন এক কঠিনতম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত উপেক্ষা ও অবজ্ঞার কারণে আমরা ১৮০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম—যা একটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে যখন উচ্চশিক্ষিত নাগরিকরা জীবন বাজি রেখে নিজেদের সাংবিধানিক অধিকারের দাবি জানাচ্ছিলেন, তখন সমাজের সেই অংশ, যারা অধিকার ও ন্যায়বিচার নিয়ে নিয়মিত সরব, তাদের নীরবতা গভীর প্রশ্ন তুলেছে। তথাকথিত অ্যাক্টিভিস্ট ও সুশীল সমাজের এই নীরবতা প্রমাণ করে—যে ইস্যুটি তাদের ব্যক্তিগত ‘ভিউ ব্যবসা’ বা রাজনৈতিক প্রচারণায় কোনো সুবিধা দেবে না, সেটিতে তারা সচেতনভাবেই চুপ থাকেন! আমাদের এই আন্দোলন তাদের কাছে কোনো ‘রাজনৈতিক পুঁজি’ নয়, তাই এই নীরবতার দায় শুধু এই নামধারী অ্যাক্টিভিস্টদের নয়, বরং তথাকথিত সচেতন সমাজ, নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীরাও দেখেও যেন না দেখার ভান করেছেন! সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলো, গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধীরা যখন নিজেদের ন্যায্য অধিকার চাইতে যান, তখন রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হতে হয়। এটি অধিকার নিশ্চিতের পরিবর্তে উল্টো নিপীড়নের চিত্র, যা রাষ্ট্রের কপালে স্থায়ী কলঙ্কের তিলক!
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের সমতা নিশ্চিত করা। এই মেধাবী গ্র্যাজুয়েটদের বিশেষ নিয়োগের ব্যবস্থা এবং উপযুক্ত মর্যাদা না দেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বের গুরুতর লঙ্ঘন। আমাদের এই দাবি কোনো করুণা নয়, বরং রাষ্ট্রের কাছে তার সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণের যৌক্তিক প্রত্যাশা। বৈষম্য দূর করে সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের জীবনমান উন্নত হবে এমন পরিবেশ তৈরি করা একটি উন্নত ও মানবিক রাষ্ট্রের নৈতিক এবং সামাজিক আবশ্যকতা। রাষ্ট্রের উচিত পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান তৈরি করা। কোন জায়গায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা কাজ করতে পারবে বা কোন জায়গায় শারীরিক প্রতিবন্ধীরা কাজ করতে পারবে—এই বিষয়গুলো রাষ্ট্রকে নিজ উদ্যোগী হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই দীর্ঘ অনশন কেবল চাকরির দাবি নয়; এটি প্রতিবন্ধী সমাজের মর্যাদা ও মূল স্রোতে অংশগ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আমাদের টানা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, সর্বশেষ গত ১২ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস. মুরশিদ আন্দোলনরত গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করে আশার আলো দেখান। তিনি আলোচনার পর জানান যে, তারা পর্যালোচনা করে দেখেছেন, প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ দেওয়ার মতো ১২৬টি আসন খালি রয়েছে। উনারা চেষ্টা করবেন এই জায়গাগুলোতে প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের অস্থায়ী নিয়োগ দিতে। তবে একইসাথে তিনি গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধীদের করা রিট তুলে নেওয়ার জন্য আহ্বান করেন।
আমরা অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলতে চাই, গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার অস্থায়ী নিয়োগের আষাঢ়ে গল্প শুনতে আন্দোলন করতে যায়নি। এমন আষাঢ়ে গল্প না শুনিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রের এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন। এমন আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে প্রতিবন্ধীদের যৌক্তিক আন্দোলন কখনোই বিনাশ করা যাবে না। যেখানে রাষ্ট্রের উচিত নিজ উদ্যোগে প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করা, সেখানে রাষ্ট্রের গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধীদের নিজেদের কর্মসংস্থানের জন্য আন্দোলন করতে হয়—এটিই আমাদের দেশের বাস্তবতা।
আপাতত গ্র্যাজুয়েট প্রতিবন্ধীরা আন্দোলন স্থগিত রেখেছেন। কেবল কাগজে-কলমে ‘সুবর্ণ নাগরিক’ বললে হবে না, এর বাস্তব প্রয়োগ দেখতে হবে। শুধু প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন তৈরি করলেই হবে না, সেটির যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। যদি সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত না আসে, তবে ফের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে। টানা আন্দোলন করতে গিয়ে হয়তো আমরা সাময়িক ক্লান্ত বা নিস্তেজ হয়ে পড়ছি, কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—আমাদের দাবির চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত এই লড়াই চলবেই! বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা বারবার লড়বো, কথা বলবো এবং অধিকার আদায় করেই নেব! এটাই আমাদের তীব্র অঙ্গীকার।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ডিজেবল স্টুডেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (ডিস্কো)। শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
