সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

| ২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

স্মরণ

একজন কামাল সিদ্দিকীর মৃত্যুতে

প্রকাশ: ১৮:৪৭, ৭ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৯:০৪, ৭ নভেম্বর ২০২৫

একজন কামাল সিদ্দিকীর মৃত্যুতে

আশির দশকে আমি তখন রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র। আমাদের সিলেবাসে রেফারেন্স বই হিসেবে অনেকগুলো বইয়ের মধ্যে একটি ছিল “বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্য: স্বরূপ ও সমাধান”, লেখক  ড. কামাল সিদ্দিকী; প্রকাশনায়: শোভা প্রকাশ। ক্লাস নেওয়ার সময় একদিন ড. হাবিবুর রহমান স্যার বইটি পড়ার জন্য আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বইটি রাজশাহীর সাহেব বাজারের একটি লাইব্রেরি থেকে কিনে পড়ি এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এসে যায়। তার মাত্র ২ বছর পর আমি সরকারি চাকরিতে ঢুকি। প্রথম পোস্টিং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, যশোর। তখন মুখে মুখে বলা হতো যশোর কালেকটরেট। সেই বৃটিশ আমলের প্রথম দিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পোস্টিং ছিল এখানে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কাকতালীয়ভাবে আমার মেয়ে লুবনার প্রথম পোস্টিংও একই অফিসে। 

যশোরে মাত্র কয়েকমাস চাকরি করা হলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুল কাদের মুন্সী স্যার আমাকে তার AC (Confidential) নিযুক্ত করেন। সংক্ষেপে বলা হয় এসি (কন)। তখন এসি (কন)-এর অফিস ছিল মূলত জেলা প্রশাসকের বাসভবনের নিচতলায়। চ্যালেঞ্জিং জব। কয়েকমাস যায়। চেম্বারে বসে টাইপিং প্র্যাকটিস করছি। হঠাৎ একদিন দিনের প্রথমবেলা—“এসি কন সাহেব, আমি কামাল সিদ্দিকী। গবেষণার কাজে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি। আমার একটু সাহায্য লাগবে।” ট্রাউজার। হালকা ধূসর রঙের শার্ট। গলায় টাই ছিল কি না মনে পড়ছে না। তিনি তখন সরকারের যুগ্ম সচিব। “আপনার লেখা বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্য: স্বরূপ ও সমাধান” আমার এখনো আত্মস্থ স্যার। এমএ করার সময় পড়েছিলাম। এখনো আমার সংগ্রহে আছে।” তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি সেবার যশোর গিয়েছিলেন আমার যতখানি মনে পড়ে জিয়াউর রহমানের দিকনির্দেশনায় যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন বিখ্যাত উলশী-যদুনাথপুর খাল খনন প্রকল্পের সাফল্য-ব্যর্থতা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য। উল্লেখ্য, উলশী-যদুনাথপুর প্রকল্প বলতে মূলত ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্তৃক খনন শুরু করা খালটিকে বোঝানো হয়। এটি একটি পাইলট প্রকল্প ছিল এবং স্থানীয়রা এটিকে শ্রদ্ধাভরে ‘জিয়া খাল’ নামেও ডাকে। তারপর তার লেখা আরও বেশ কয়টি বই পড়েছি। পরবর্তীতে আমি যখন নওগাঁয় চাকরি করি—কামাল সিদ্দিকী স্যার সেখানে যান একটি বড় ধরনের সমন্বয়মূলক সভায় কথা বলার জন্য। হাফ শার্ট। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। বেল্টবিহীন। তেমন কথা বলার সুযোগ পাইনি। তবু যশোরের কথা বলেছিলাম। সহজ আচরণ। সাধারণ বেশবাস।

কামাল সিদ্দিকী। পুরো নাম ড. কামালউদ্দিন সিদ্দিকী। জ্ঞানের জাহাজ। সার্বক্ষণিক জ্ঞানপিপাসু। নিশ্ছিদ্র দেশপ্রেমিক। আপসহীন, সৎ, সত্যনিষ্ঠ ও সৎসাহসী। তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত অথবা তারও কিছু বেশি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময় কামাল সিদ্দিকী নড়াইলের সাব-ডিভিশনাল অফিসার (এসডিও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে চলে যান। তিনি ১২ এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছান। তিনি ঘোজাডাঙ্গা-সাতক্ষীরা সীমান্তে একটি ক্যাম্পে থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন ডালিম। জুন মাসে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী ঘোজাডাঙ্গা মুক্তিযুদ্ধ ঘাঁটি পরিদর্শনে এসে তাকে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব নিযুক্ত হন। [উইকিপিডয়া] মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা সম্পর্কে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং আরও বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির স্মৃতিচারণে উল্লেখ আছে। আমীর-উল ইসলাম তার "মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি" গ্রন্থের ৩০ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন,  "মাগুরার মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। স্থানীয় কর্মীরা তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। সিদ্দিকী আমার পূর্বপরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে সিদ্দিকীকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল।"

নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং খুলনা জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যখন যে পদে চাকরি করেছেন, সোনালি সাফল্যের ছাপ রেখেছেন। বাংলাদেশে বিএনপির আমলে সর্বশেষ সার্ক সম্মেলন মূলত তার ক্যারিশমাটিক ভূমিকার কারণে শেষপর্যন্ত সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল বলে আমাদের কয়েকজন সিনিয়র তখনই মন্তব্য করেছিলেন।

তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন। আমি যতটুকু শুনেছিলাম, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্য ২ বছরের সিনিয়রিটি “নীতিগত কারণে” গ্রহণ করেননি।

কামাল সিদ্দিকীর লেখা অনেকগুলো বই আমার সংগ্রহে আছে। তার ইংরেজি ভাষায় লিখিত বইগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সহজ ও সাবলীল ইংরেজি। আমার মতো আধা ইংরেজি জানা পাঠকও সেসব লেখা মোটামুটি অনুসরণ করতে পারেন। কিন্তু আমার আরেক প্রিয় লেখক ড. আকবর আলি খানের ইংরেজি অনুসরণ করতে গেলে আমাকে হাতের কাছে ডিকশনারি রাখতে হয়। ড. কামাল সিদ্দিকীর লেখা কয়েকটি বইয়ের নাম:

১. বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি, ১৯৭৯, ঢাকা।

২. বাংলাদেশে ভূমি-সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি, ১৯৮০, বাংলদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা, ঢাকা। 

৩. বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র : স্বরূপ ও সমাধান । 

৪. দক্ষিণ এশিয়ায় মেগাসিটি গভর্নেন্স : একটি তুলনামূলক অধ্যয়ন, ২০০৪, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা।

৫. দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমি ব্যবস্থাপনা: একটি তুলনামূলক গবেষণা, ১৯৯৭, ঢাকা।

৬. বাংলাদেশে আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ, ১৯৯১, স্থানীয় সরকার জাতীয় ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

৭. গ্রামীণ ব্যাংক অপারেশনের একটি মূল্যায়ন, ১৯৮৪, ঢাকা।

৮. বাংলাদেশে সুশাসনের দিকে: পঞ্চাশ অপ্রীতিকর রচনা, ১৯৯৬, ঢাকা। 

৯. ঢাকা সিটিতে সামাজিক গঠন, ১৯৯৩, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা।

১০. বাংলাদেশে স্থানীয় শাসন: প্রধান সমস্যা এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ, ২০০০,ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা। 

১১. জগৎপুর, ১৯৭৭-৯৭: গ্রামীণ বাংলাদেশে দারিদ্র ও সামাজিক পরিবর্তন,২০০০, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা।

কত সহকর্মী মারা যান, আমি তাদের নিয়ে কিছু লেখার তাড়না অনুভব করি না। কিন্তু যখন ড. আকবর আলি খান-ড. কামাল সিদ্দিকীদের মতো কেউ ইহলোক থেকে বিদায় নেন, তখন লিখতে ইচ্ছা জাগে। চাকরিজীবনে আমি এমনিতেও কোনোদিন কোনো সিনিয়রের কাছে কোনোকিছুর জন্য যাইনি বললেই চলে। কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে একদিনও চাকরি করিনি। চাকরিজীবনে কখনও কোনও প্রয়োজনে তার কাছে যাইনি। কিন্তু তিনি আমার শিক্ষক। ছাত্রজীবনে তার লেখা বই পড়েছি। চাকরিজীবনে তার লেখা অনেক বই পড়েছি। ট্রেনিংয়ের সময় তার লেকচার শুনেছি মনোযোগ সহকারে। বাংলাদেশকে নিয়ে তার কত সুসন্তানের, কত সৃজনশীল স্বপ্ন ছিল—কিন্তু বহুবিধ ও বহুমাত্রিক কারণে সেসব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ প্রায়। নাম মনে নেই,—মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক কবি তার একটি প্রেমের কবিতায় লিখেছিলেন যার বাঙলায়ন মোটামুটি এমন:

“তোমার কাছে বসতে এলাম
বসতে দিলে পিছে
সাগর জলে শ্যাওলা ভাসে 
মুক্তা থাকে নিচে।”

ড. কামাল সিদ্দিকী ৩ নভেম্বর খুব ভোরে মৃত্যবরণ করেছেন। এই গুণী মানুষটির মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তার বিদেহী আত্মা চিরশান্তির স্থান লাভ করুক—এই প্রার্থনা করি।

লেখক: কবি ও নজরুল গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা 

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

শেখ রেহানাসহ ১৭ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি গ্রহণ
ঢাকায় একাধিক স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ
খুলনায় নানি ও দুই নাতি-নাতনির মরদেহ উদ্ধার
উপদেষ্টা রিজওয়ানার বাসার সামনে ককটেল বিস্ফোরণ
কাপ্তাই সড়কে সিএনজির উপর হাতির হামলা, প্রাণ গেল বৃদ্ধার
স্টারবাকস বয়কটের ডাক মেয়র জোহরান মামদানির
ইন্দোনেশিয়ায় ভূমিধসে নিহত বেড়ে ১১, নিখোঁজ ১২
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া ফ্যাসিবাদ হটানো সম্ভব নয়—জোনায়েদ সাকি
পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে ব্যাপক রদবদল, ১৫ কর্মকর্তার বদলি
সারাদেশে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৭০০
যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য কড়াকড়ি
ট্রেনের লাগেজ ভ্যান কেনায় ৩৫৮ কোটি টাকার ক্ষতি, রেলের ছয় কর্মকর্তা দুদকের মামলার মুখোমুখি
ট্রেনের লাগেজ ভ্যান কেনায় ৩৫৮ কোটি টাকার ক্ষতি, রেলের ছয় কর্মকর্তা দুদকের মামলার মুখোমুখি
মোহাম্মদপুরে ৬ পেট্রল বোমা উদ্ধার, আটক ১
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন প্রেম চোপড়া
লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে নতুন বিতর্কে কঙ্গনা রানাউত
বিভিন্ন দেশের ১৫ হাজার প্রবাসীকে ফেরত পাঠালো সৌদি আরব
১০ বছর পর বড় পর্দায় ফিরছেন বজরঙ্গি ভাইজানের ‘মুন্নি’
চুড়ান্ত নিবন্ধন দৌঁড়ে এগিয়ে এনসিপি ও বাসদ, পিছিয়ে আমজনগণ পার্টি
গাজা পরিকল্পনা নিয়ে জাতিসংঘে ভোট সোমবার