ভার্চুয়াল ক্যাসিনোর আগুনে স্বপ্ন পুড়ে ছাই
প্রকাশ: ১৭:০২, ৪ নভেম্বর ২০২৫
						
									দেশের তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ আজ এক অদৃশ্য ফাঁদে আটকে যাচ্ছে—অনলাইন জুয়া। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক কিংবা টেলিগ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে ‘বেটিং’ নামের এক নতুন নেশা। এক ক্লিকেই শুরু হয় খেলা, আর এক সময় সেটিই জীবনের ভয়াবহ অভ্যাসে পরিণত হয়। কৌতূহল থেকে শুরু হলেও এই নেশা এখন তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
অনলাইন জুয়া এখন হাতের মোবাইলেই। আগে জুয়া মানে ছিলো লুকিয়ে খেলা, পুলিশের ভয়, সামাজিক লজ্জা। এখন সেই জুয়া চলে ঘরে বসেই। ‘স্পোর্টস বেটিং’, ‘ক্যাসিনো অ্যাপ’, ‘লাইভ গেম’—এমন অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। কেউ দিনে ২০০ টাকা বাজি ধরে, কেউ রাতে হাজারে হাজার টাকা হারায়। প্রথমে ছোট অঙ্কে জিতে উত্তেজনা বাড়ে, তারপর বড় বাজি, ঋণ আর পরাজয়। অনেকেই শেষে হারায় আত্মসম্মান ও মানসিক স্থিরতা।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনলাইন জুয়া মাদকের মতোই এক ধরনের মানসিক আসক্তি।
খেলোয়াড়ের মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসৃত হয়, যা তাকে জয়ের উত্তেজনায় বেঁধে রাখে। ফলে সে বারবার খেলায় ফিরে আসে, হারলেও থামতে পারে না। এর পরিণতি ভয়াবহ—হতাশা, আত্মগ্লানি, মানসিক অস্থিরতা। অনেক তরুণ ঘুমহীন রাত কাটায়, পরিবার থেকে দূরে সরে যায়, পড়াশোনা বা কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এই জুয়ার প্রভাব এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, পারিবারিক ও সামাজিকও। প্রতিদিন খবর আসে, ছাত্রের বিকাশের টাকা হারিয়ে গেছে, চাকরিজীবী বেতনের সবটাই বাজিতে উড়িয়ে দিয়েছে, কেউ কেউ চুরিতেও নেমেছে বাজির টাকা জোগাতে। অনেক পরিবারে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বাসের সংকট, সম্পর্কের দূরত্ব, আর্থিক অস্থিরতা। অনলাইন জুয়ার অগ্নিতে পুড়ছে পারিবারিক শান্তি।
সমস্যা এখানেই শেষ নয়। এই জুয়ার অর্থের বড় অংশ বিদেশে পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন বিদেশি সাইটের মাধ্যমে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মানি লন্ডারিং ও সাইবার প্রতারণার ঝুঁকি। দেশে ডলার সংকট চললেও এই অবৈধ লেনদেন কেউ নজরে রাখছে না।
কিছু ইউটিউবার ও টিকটকার আবার এই জুয়ার প্রচারে যুক্ত হয়ে তরুণদের ফাঁদে ফেলছে। তারা দেখায়, 'এক ঘণ্টায় আয় ১০ হাজার টাকা'—বাস্তবে যা কল্পনার ফাঁদ ছাড়া কিছুই নয়।
সরকার কয়েক দফা বেটিং সাইট বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। এক সাইট বন্ধ হলে নতুন নামে আরেকটি চালু হয়। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও কার্যকরভাবে ঠেকাতে পারছে না। বাস্তবতা হলো, অনলাইন জুয়া এখন এক প্রজন্মের মানসিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
এই আসক্তি রোধে প্রথম দায়িত্ব পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। অভিভাবকদের জানতে হবে সন্তান অনলাইনে কী করছে, কোথায় সময় দিচ্ছে, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। শুধু নিষেধ নয়, দরকার বোঝানো ও বিকল্প ব্যস্ততা তৈরি। স্কুল-কলেজে ডিজিটাল সচেতনতা বিষয়ক কর্মশালা, আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে। তরুণদের খেলাধুলা, সংস্কৃতি, উদ্যোক্তা কার্যক্রমে যুক্ত করা গেলে অনলাইন আসক্তি অনেকটাই কমে যাবে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও দরকার কঠোর পদক্ষেপ। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেট গেটওয়ে পর্যায়ে এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করা, মোবাইল পেমেন্ট সার্ভিস থেকে বিদেশি সাইটে টাকা পাঠানো বন্ধ করা জরুরি।
অনলাইনে যারা এসব জুয়ার প্রচারে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে আসক্ত তরুণরা ফিরে আসার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশের তরুণরাই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের স্বপ্ন, পরিশ্রম ও সৃজনশীলতাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কিন্তু যদি এই প্রজন্ম অনলাইন জুয়ার নেশায় ডুবে যায়, তাহলে সেটি শুধু ব্যক্তিগত বিপর্যয় নয়, জাতির ক্ষতি। এই নেশা তরুণদের শেখাচ্ছে ভাগ্যের ওপর নির্ভরতা, পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা আর সহজে অর্থ পাওয়ার মায়া। অথচ বাস্তব জীবনে কোনো শর্টকাট নেই।
এখনই সময় সচেতন হওয়ার। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র—সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণদের বোঝাতে হবে, অনলাইন জুয়া বিনোদন নয়, এটি আত্মবিনাশের খেলা। আজ যদি আমরা চুপ থাকি, কাল হয়তো পুরো একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাবে এক ক্লিকের ভেতর।
তরুণ প্রজন্ম অনেক স্বপ্ন নিয়ে জড়িত হচ্ছে ভার্চুয়াল ক্যাসিনোয়। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে তাদের স্বপ্ন পড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তাই অনলাইন নেশার এই আগুন থেকে তরুণদের বাঁচাতে এখনই দরকার বাস্তব পদক্ষেপ, কথায় নয়, কাজে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
