শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

| ১৬ কার্তিক ১৪৩২

সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে উভয় সংকটে বিএনপি 

প্রকাশ: ১৪:১০, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে উভয় সংকটে বিএনপি 

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা পড়তেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে সরকার ও ঐকমত্য কমিশন বলছে, সংবিধান সংস্কার ও গণভোটের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, এটি একতরফা, অগণতান্ত্রিক ও জনগণের মতামতকে পাশ কাটিয়ে নেয়া এক রাজনৈতিক কৌশল। বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রকাশের পর থেকেই দলটি পড়েছে উভয় সংকটে—গ্রহণ করলেও সমস্যা, প্রত্যাখ্যান করলেও রাজনৈতিক বিপদ।
বিএনপির নেতারা বলছেন, কমিশনের সুপারিশে তাদের দেয়া 'ভিন্নমত' বা 'নোট অব ডিসেন্ট' অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কমিশন যখন জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্যের সুপারিশ তৈরি করছিলো, তখন বিএনপি কিছু মৌলিক পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়—বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার, ক্ষমতার ভারসাম্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে। কিন্তু কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে এসব বিষয়ের প্রতিফলন নেই বলে অভিযোগ করেছে তারা। দলটির মতে, এমন এক প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের পথে গেলে তা দেশের রাজনীতিকে আরও মেরুকরণের দিকে ঠেলে দেবে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে গণভোট আয়োজনের পরিকল্পনাও রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের নির্দিষ্ট কিছু ধারা সংশোধন করা হবে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ নামে একটি বিশেষ আদেশ জারি করবে। এই পদক্ষেপে বিএনপির আপত্তি স্পষ্ট। তারা মনে করে, সরকারের এ ধরনের এখতিয়ার নেই এবং গণভোটের আয়োজনও নিরপেক্ষভাবে সম্ভব নয়। দলের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, 'যে সরকারের অধীনে জনগণের ভোটের অধিকারই সুরক্ষিত নয়, তারা গণভোট আয়োজন করবে—এটা জনগণ বিশ্বাস করবে না।'
এ অবস্থায় বিএনপির জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যদি সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সংস্কার প্রক্রিয়ার বিরোধী হিসেবে তাদের অবস্থান দাঁড়াবে। এতে সরকার ও তার সমর্থক মহল বিএনপিকে 'সংস্কারবিরোধী' বলে প্রচার চালাতে পারবে। আবার যদি তারা সুপারিশ মেনে নেয়, তাহলে তাদের আগে দেয়া অবস্থান—নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি ও সনদের কিছু মৌলিক বিষয়ের বিরোধিতা—সবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, গ্রহণ করলেও রাজনৈতিক ক্ষতি, না করলেও বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি।
গণমাধ্যমের  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের সুপারিশে কিছু পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যেমন প্রশাসনিক সংস্কার, নির্বাচন কমিশনের প্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে কিছু সংশোধন। এসব বিষয়ে বিএনপির আপত্তি কম। কিন্তু মূল বিতর্ক সংবিধান সংশোধন, গণভোটের সময়সূচি ও 'সংসদের উচ্চকক্ষ' গঠন নিয়ে। কমিশন বলেছে, গণভোটে অনুমোদন পেলে ২৭০ দিনের মধ্যে নতুন সংসদ সংবিধান সংশোধনের কাজ সম্পন্ন করবে এবং উচ্চকক্ষসহ একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন হবে। বিএনপি বলছে, এই কাঠামোতে সরকারের প্রভাব এতোটাই প্রবল যে ভবিষ্যতে বিরোধী দলের কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে যাবে।
অন্যদিকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মনে করছে, সংস্কারের এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ভারসাম্য আনবে। তাদের বক্তব্য 'সংবিধান পরিবর্তন বা উচ্চকক্ষ গঠন কোনো দলের জন্য নয়, দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য। বিএনপি যদি সত্যিই সংস্কার চায়, তাহলে অংশ নিক; বাইরে থেকে সমালোচনা করে সমাধান পাওয়া যাবে না।' আওয়ামী লীগের এই বক্তব্য বিএনপির ওপর পরোক্ষ চাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিএনপি এখন চেষ্টা করছে কৌশলগত অবস্থান রক্ষা করার। দলটির ভেতরে মতবিভাজনও আছে—এক অংশ বলছে, 'সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে সময় নিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত', অন্য অংশ বলছে, 'এটি সরকারের তৈরি ফাঁদ, অংশ নিলেই দল বৈধতা দেবে একতরফা প্রক্রিয়াকে।' ফলে কেন্দ্রিয় নেতাদের সভা থেকে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। দলটি ঘোষণা দিয়েছে, কমিশনের সুপারিশ আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষা করে পরবর্তীতে অবস্থান জানানো হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি যদি সুপারিশ নিয়ে সরাসরি ‘না’ বলে দেয়, তাহলে সরকার তাদের সংস্কারবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আবার যদি তারা অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়, তাহলে দলটির আন্দোলন ও নির্বাচনী দাবি—দুটিই দুর্বল হয়ে যাবে। এ কারণেই এটাকে 'উভয় সংকট' বা 'দ্বৈত ফাঁদ' বলছেন বিশ্লেষকেরা।
একই সঙ্গে দলের সামনে আরও একটি বাস্তব সংকট রয়েছে—নির্বাচন ঘিরে অবস্থান। যদি গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হয়, যেমনটি আলোচনায় এসেছে, তাহলে বিএনপির সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত থাকবে—তারা কি নির্বাচনে অংশ নেবে, নাকি গণভোট বর্জনের আহ্বান দেবে। দুটি সিদ্ধান্তই দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, বিএনপির বর্তমান দ্বিধা তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই উৎসারিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই দলটি ক্ষমতার বাইরে, আন্দোলনে পর্যাপ্ত সাফল্যও পায়নি। এখন যদি তারা এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে, তাহলে তারা বাস্তব রাজনীতির বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। অন্যদিকে অংশগ্রহণ করলে তা 'সরকারের নকশায় অংশগ্রহণ' হিসেবে দেখা হতে পারে। এই বাস্তবতার কারণে বিএনপি নেতৃত্ব এখন খুব সতর্কভাবে প্রতিটি বক্তব্য দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্কারের সুপারিশের মধ্যেই বিএনপির জন্য সুযোগও আছে, যদি তারা তা কৌশলে ব্যবহার করতে পারে। গণভোট ও সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ায় তারা জনমত সংগঠিত করতে পারে, সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ও আইনি সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রচার চালাতে পারে। এতে দলটি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও প্রাসঙ্গিক থাকবে। কিন্তু আপাতত তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া।
রাজনীতিতে কখনো কখনো নীরবতাও কৌশল। বিএনপি হয়তো সেই পথেই হাঁটছে এখন। তবে সময়ের ব্যবধানে যদি সরকার সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হয়, আর বিএনপি দ্বিধায় থাকে, তাহলে সেটি দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য আরও কঠিন পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সংস্কার বাস্তবায়নের এই মুহূর্তে বিএনপি ঠিক সেই দ্বিধার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে—একদিকে অংশগ্রহণ মানে নীতি থেকে সরে আসা, অন্যদিকে বিরোধিতা মানে রাজনীতির মঞ্চ থেকে আরও একধাপ পিছিয়ে পড়া।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই পরিস্থিতি নতুন নয়, কিন্তু এবার ঝুঁকি  অনেক বেশি। কারণ, জুলাই সনদ শুধু একটি রাজনৈতিক চুক্তি নয়—এটি ভবিষ্যৎ শাসন কাঠামো, সংবিধান, এমনকি নির্বাচনের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। তাই বিএনপির প্রতিটি সিদ্ধান্তই এখন মাপা হবে শুধু বর্তমান রাজনীতির ভিত্তিতে নয়, ইতিহাসের আয়নায়ও।


লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় প্রশ্ন তুলল এমএসএফ অজ্ঞাতনামা লাশ ও হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে
মধ্যপাড়া পাথর খনি ভবানীপুর রেলপথে রেললাইনের ৬ হাজার নাটবল্টু চুরি
অধিকারের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার
জেডি ভান্সের আশা, স্ত্রী ঊষা একদিন গ্রহণ করবেন খ্রিষ্টান ধর্ম
নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই, গণভোটের সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা
নির্বাচনের আগে গণভোটের কোনো সুযোগ এখন আর নেই: মির্জা ফখরুল
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৬১ আসামি পলাতক, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলো সিআইডি
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৬১ আসামি পলাতক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলো সিআইডি
বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার কারণ জানতে চেয়ে সদুত্তর পাইনি
আজ শেষ হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ
জুবিনের শেষ সিনেমা মুক্তি পেল আসামে, ৯০ হলে টিকিট ‘হাউসফুল’
২০২৬ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী প্রবেশের সীমা ৭৫০০ জন
সঞ্চয়পত্র জালিয়াতিতে সাবেক ছাত্রদল নেতার নাম, চাঞ্চল্যকর তথ্য উন্মোচন