সিএনএনের বিশ্লেষণ
ট্রাম্প-শি বাণিজ্য বৈঠকে সুবিধাজনক অবস্থানে চীন
প্রকাশ: ১৪:০৯, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
 
						
									দক্ষিণ কোরিয়ার গিমহে আন্তর্জাতিক বিমান বেইসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের দুই ঘণ্টারও কম সময়ের বৈঠকের অংক ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছে। আর এখন স্পষ্ট— যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কঠোর আলোচনার কৌশলে চীন আবারও এক ধাপ এগিয়ে গেল।
এই বৈঠকে কোনও পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য চুক্তি হয়নি, তবে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির মতো সমঝোতা হয়েছে— যা সম্পর্কটিকে স্থিতিশীল রাখবে যতক্ষণ না উভয়পক্ষ আরও বড় চুক্তির পথে এগোয়।
বৈঠক শেষে শি চিনপিং ৩০ শতাংশ শুল্কের মধ্যে ১০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন— যা ট্রাম্প এই বছর চীনা পণ্যের ওপর আরোপ করেছিলেন। বিনিময়ে চীন যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল সংকট মোকাবিলায় আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিপুল সংখ্যক প্রযুক্তি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করার নতুন নিয়ম স্থগিত করতে রাজি হয়েছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প বাঁচাতে পেরেছেন— বেইজিং যদি বিরোধিতায় তার বিরল খনিজ পদার্থের রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করত, তাহলে বৈশ্বিক শিল্পক্ষেত্রে তা ভয়াবহ প্রভাব ফেলত।
চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন ও অন্যান্য কৃষিপণ্য ক্রয় বাড়াতে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি, উভয় দেশই একে অপরের শিপিং খাতে অতিরিক্ত বন্দর ফি স্থগিত করছে এবং উচ্চ শুল্কের নতুন রাউন্ডও আপাতত বন্ধ থাকবে।
কাগজে-কলমে, এটি একটি যুক্তিসঙ্গত বিনিময় চুক্তি— যা আপাতত উভয় দেশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও কাঙ্ক্ষিত স্থিতি এনে দিয়েছে, এক বছরের উত্তাল টানাপোড়েনের পর।
কিন্তু বেইজিংয়ের জন্য এই সমঝোতা কেবল আর্থিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শুল্ক ছাড় ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে ছাড় পাওয়ার পরও তারা যে ছাড় দিয়েছে, তা মূলত এমন ক্ষেত্রেই— যেগুলো তারা আগেই প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে আরোপ করেছিল।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রপ্তানি পণ্য সয়াবিনের কথা। চীন সম্মত হয়েছে, আগামী তিন বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর অন্তত ২ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন কিনবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিমন্ত্রী ব্রুক রোলিন্স জানিয়েছেন, এই পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন কম।
চীনের সামাজিক মাধ্যমে শুক্রবার থেকেই সাড়া পড়ে গেছে— অনেকেই লিখেছেন, “চীন আসলেই এই শুল্কযুদ্ধে জয়ী হয়েছে” এবং “ট্রাম্প অবশেষে নিজের তৈরি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে বাধ্য হয়েছেন।”
তবে সব দিক থেকেই চীনের চিত্র উজ্জ্বল নয়। এই বছরের নতুন শুল্ক কিছুটা কমলেও, যুক্তরাষ্ট্রের আগের সব শুল্ক মিলিয়ে চীনা পণ্য এখনো গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ শুল্কের মুখে— যা যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সর্বোচ্চ হারের একটি।
তবুও ওয়াশিংটন তার উদ্দেশ্য— বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে— উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখছে।
অন্যদিকে, টিকটকের মালিকানার প্রশ্নে চীন কিছুটা নরম অবস্থানে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে বাইটড্যান্সকে যুক্তরাষ্ট্র অংশ বিক্রি করতে হবে— আগে যার বিরোধিতা করেছিল বেইজিং। এখন তারা এ নিয়ে আপসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তবে উচ্চমানের মার্কিন চিপ প্রযুক্তি এখনো চীনের জন্য নিষিদ্ধ। এ কারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রতিযোগিতায় চীন এখনো বড় সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে।
তবুও প্রযুক্তি খাতে একটি বড় সাফল্য পেয়েছে বেইজিং— যুক্তরাষ্ট্রের যে নতুন নিয়মটি কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দিত, সেটি অন্তত এক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। ব্যবসায়িক বিশ্লেষণ সংস্থা “ওয়্যারস্ক্রিন”-এর হিসেবে, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে অতিরিক্ত ২০ হাজার কোম্পানি যুক্ত হতো ওই তালিকায়।
এই স্থগিতাদেশ চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য বড় স্বস্তি— যা এসেছে বেইজিংয়ের এক কৌশলগত অস্ত্র থেকে: বিশ্বের বিরল খনিজ সরবরাহের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ। এরই মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে।
চীন তার বিরল খনিজ রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল, সেটি অন্তত এক বছরের জন্য স্থগিত রেখেছে। বেইজিংয়ের কাছে এটি বড় ক্ষতি নয়।
চীনা পররাষ্ট্র বিশ্লেষক শেন ডিংলি সম্প্রতি সিএনএনকে বলেছিলেন, “এই খনিজ রপ্তানি বন্ধ করা ছিল একপ্রকার পারমাণবিক বিকল্প— আমরা জানতাম এটি সমান প্রতিশোধ নয়। কিন্তু চীন যদি এই অস্ত্র ব্যবহার না করে, তবে আলোচনায় তার হাতিয়ারও ফুরিয়ে যাবে।”
এখন প্রশ্ন— ট্রাম্প ও শি কি এই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ধরে রাখতে পারবেন, যতক্ষণ না তারা পূর্ণাঙ্গ চুক্তির দিকে এগোন এবং ২০২৬ সালে একে অপরের দেশ সফরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন?
কানাডা জানে— ট্রাম্পের সঙ্গে করা কোনও বাণিজ্য বিরতি কত দ্রুত ভেঙে পড়তে পারে।
বহু অজানা ঝুঁকি ও কাঠামোগত দ্বন্দ্ব এখনো বিদ্যমান, যা সহজেই নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি চূড়ান্ত কোনও চুক্তি হলেও, তা দুই দেশের গভীর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব মেটাতে পারবে না।
বৃহস্পতিবার ট্রাম্প যখন দক্ষিণ কোরিয়ার গিমহে বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরেন— তখন দেশে অপেক্ষা করছিল অচলাবস্থায় থাকা এক সরকার। অন্যদিকে, শি চিনপিং সেখানেই থেকে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং চীনকে “বিশ্বায়নের আলোকবর্তিকা” হিসেবে তুলে ধরেন।
এখন ছবিটা পরিষ্কার— বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক এই রাউন্ডে, ক্ষমতার পাল্লা আপাতত বেইজিংয়ের দিকেই ঝুঁকেছে।
অনুবাদ: সমাজ কাল ডেস্ক
মূল লেখক :সিমোন ম্যাকার্থি, সিএনএন

 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													