মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

| ২৭ কার্তিক ১৪৩২

মাথার ওপর ঝুঁকি, বরাদ্দ দিয়ে দায় শেষ হয় কি?

প্রকাশ: ১৫:২২, ২৮ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ২১:৫৯, ২৮ অক্টোবর ২০২৫

মাথার ওপর ঝুঁকি, বরাদ্দ দিয়ে দায় শেষ হয় কি?

হাবীব ইমন

মেট্রোরেল—ঢাকা নগর পরিকল্পনার এক আধুনিক প্রতীক। এটি প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষকে শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট থেকে মুক্ত করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কিন্তু ২৬ অক্টোবর ফার্মগেটে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিল—যে সুবিধা অর্জন করা হয়েছে, তার সঙ্গে এক ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতাও জড়িয়ে আছে। উপরে বসানো বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে এক তরুণ—আবুল কালাম আজাদ—মৃত্যুর মুখে পড়েন। নগরবাসী, যারা প্রতিদিন মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে হাঁটে, তারা এক নতুন শঙ্কায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়।

সকাল মানে একটি নতুন দিনের শুরু, নতুন সম্ভাবনা। আবুল কালাম আজাদও হয়তো এমনই এক সকালে বেরিয়েছিলেন নিজের স্বপ্নের পথে। শরীয়তপুরের মানুষ, থাকতেন নারায়ণগঞ্জে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে। পকেটে পাসপোর্ট ছিল—অর্থাৎ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল বিস্তৃত। হয়তো ভেবেছিলেন, বিদেশে গিয়ে জীবন বদলাবেন। কিন্তু ফার্মগেটের টং দোকানে চা খেতে খেতে যে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন, সেখান থেকেই ঝরে পড়ল লোহার ভারী প্যাড, মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল সবকিছু।

এই শহরে মানুষের মৃত্যু এমনই সস্তা। হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের এ শহরে প্রাণটাই সবচেয়ে কম দামি। একটি লোহার রড পড়ে, বা ভবনের ছাদ থেকে একটি ফুলের টব পড়েও মানুষ মারা যায় এখানে। মনে পড়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপুর কথা—অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলেন, শান্তিনগরে উড়ালসড়ক থেকে ইট উড়ে এসে তার মাথায় লাগে; এক মুহূর্তেই মৃত্যু।

আবুল কালামের মৃত্যু কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি এটি একটি কাঠামোগত হত্যা—যেখানে অব্যবস্থাপনা, তদারকির অভাব এবং দায়িত্বহীনতা মিলিত হয়ে এক প্রাণ কেড়ে নেয়? এর দায় কার? পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ কি সেই দায় মুছে দেয়? কোটি কোটি টাকা দিয়েও একটি প্রাণের মূল্য হয় না জানি। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকায় নির্মিত মেট্রোরেলের বলি হওয়া জীবনের মূল্য মাত্র পাঁচ লাখ টাকা—এই অমিলই আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার প্রতিচ্ছবি।

সরকারি প্রক্রিয়ায় সবকিছু ‘ঠিকমতো’ করা হয়েছে বলে জানানো হয়। নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা সহায়তা, ভবিষ্যতে চাকরি ও শিক্ষার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্নটি থেকে যায়—অর্থ বরাদ্দ কি প্রকৃত দায়বদ্ধতার সমার্থক? মেরামতের বরাদ্দ, ক্ষতিপূরণ বা কমিটি গঠনের ঘোষণা কেবল ক্ষণস্থায়ী প্রতিকার। এতে মানুষের জীবন বা আস্থা কোনোদিনই ফিরিয়ে আনা যায় না।

মেট্রোরেল প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ মাত্র ১৩ মাসে দুটি দুর্ঘটনা—প্রমাণ করে, প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে যথাযথ তদারকি, নিরাপত্তা নিরীক্ষা এবং মাননিয়ন্ত্রণ ছিল না। ব্যয়বহুল প্রকল্পের সাফল্য শুধু ইস্পাত আর কংক্রিটের ওপর নির্ভর করে না—এটি নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের নৈতিকতার ওপর, যে রাষ্ট্র মানুষের জীবনকে তার উন্নয়ন নীতির কেন্দ্রে রাখে।

রাষ্ট্র, যখন উন্নয়নের নামে আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখাতে থাকে, তখন সে প্রায়ই ভুলে যায়—উন্নয়ন মানে শুধু সংখ্যার যোগফল নয়; উন্নয়ন মানে মানুষের নিরাপত্তা, জীবনের মর্যাদা, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের উন্নয়ন যেন একধরনের আত্মপ্রচারের নেশা—যেখানে দায়বদ্ধতা নেই, শুধু গর্ব আছে। মেট্রোরেল সেই গর্বের প্রতীক, আবার আজ সেটাই নাগরিকের মাথার ওপর ঝুলে থাকা আশঙ্কার প্রতীক।

ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প—একসময় একে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের দিন একে উন্নত রাষ্ট্রের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলেছিলেন। কিন্তু আজ সেই প্রকল্পের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক তরুণ পথচারীর মৃত্যু রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে এক ভয়াবহ প্রশ্ন রেখে গেল—এই উন্নয়ন কাকে ঘিরে, আর কার জন্য?

এটা কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়; এটা রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার প্রতীক। প্রতিটি ভুলের দায় ঢেকে দেওয়া হয় টাকার মাধ্যমে, সহানুভূতির ঘোষণার মাধ্যমে। রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি গিয়ে পরিবারকে সান্ত্বনা দেন, ক্ষতিপূরণ দেন, কিন্তু রাষ্ট্রের দায় কি এতেই শেষ হয়? নাকি আসলে এখান থেকেই সেই দায়ের শুরু হওয়া উচিত ছিল? রাষ্ট্র এখানে একধরনের বেপরোয়া নির্মাতা, যে চায় কাজ হোক দ্রুত, দৃশ্যমান ফলাফল দেখাক, কিন্তু দেখতে চায় না ভেতরের ফাটলগুলো।

দার্শনিক জাঁ বোধরিয়ার এক জায়গায় বলেছিলেন, “যখন বাস্তব হারিয়ে যায়, তখন কেবল তার প্রতিরূপ টিকে থাকে।” বাংলাদেশের উন্নয়নও আজ যেন সেই প্রতিরূপ—বিলবোর্ডে ঝুলে থাকা উজ্জ্বল ছবি, যার নিচে অন্ধকারে পড়ে থাকে একজন আবুল কালামের মৃতদেহ। আমরা শিখেছি উন্নয়নকে দেখতে, অনুভব করতে নয়; তাই মেট্রোরেলের নিচে পড়ে থাকা লাশ রাষ্ট্রকে নড়ায় না, শুধু তাৎক্ষণিক আলোচনার বিষয় হয়।

২৬ অক্টোবরের এই দুর্ঘটনা শুধু এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়; এটি নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা ও আস্থার এক গভীর ক্ষত। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় মানুষ বিপর্যস্ত হয়—অফিস, স্কুল, হাসপাতাল, ডে কেয়ার—সবই থমকে যায়। আর সেই থমকে যাওয়া শহরের নীরবতার ভেতর দিয়ে ভেসে আসে এক প্রশ্ন—আমরা কি সত্যিই নিরাপদ?

রাজনৈতিক অর্থে মেট্রোরেল দুই দিকের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আধুনিক প্রযুক্তি, দ্রুত যাতায়াত এবং নাগরিক সুবিধার মাধ্যমে উন্নয়নের প্রতীক, কিন্তু একই সঙ্গে এটি ক্ষমতার প্রতীক—যেখানে ব্যয়বহুল অবকাঠামো সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও ইমেজকে তুলে ধরে, আর নাগরিক নিরাপত্তার ঘাটতি স্পষ্ট করে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা—উভয় ঘটনাই এই দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করেছে।আন্দোলনের সময় মেট্রোরেলকে লক্ষ্য করে হামলা হয়েছিল, যা শুধু রাজনৈতিক ক্ষোভ নয়—এটি নাগরিক হতাশা ও রাষ্ট্রীয় অবিশ্বাসেরও বহিঃপ্রকাশ।

দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে, সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা অডিট ও স্বাধীন তদারকি কতটা অপরিহার্য। উন্নয়ন মানে শুধু নতুন প্রকল্প নয়—এটি মানে জবাবদিহি, সতর্কতা, আর মানবজীবনের প্রতি শ্রদ্ধা। রাষ্ট্র যদি কেবল অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তার দায় শেষ করতে চায়, তবে প্রতিটি লাশই একদিন ‘বাজেটের লাইন’ হয়ে যাবে।

রাষ্ট্র যখন দায় এড়িয়ে শুধু সাফল্যের পরিসংখ্যান নিয়ে মেতে থাকে, তখন সেই রাষ্ট্র ধীরে ধীরে নৈতিক মৃত্যু বরণ করে। আর নাগরিক? তারা হাঁটে মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে, মাথার ওপর ঝুলে থাকে অদৃশ্য এক আশঙ্কা—উন্নয়নের নামে নির্মিত মৃত্যুর ছায়া।

এবং তখন একটিই প্রশ্ন রয়ে যায়—মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা রাষ্ট্র কবে দেবে?

লেখক: কলামিস্ট ও লেখক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

ঢাবি মৃৎশিল্প বিভাগের বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শুরু
গুলশান লেকে ছাত্রদল কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা
ওড়িশি নৃত্যালেখ্য ও নৃত্যকলার অনবদ্য পরিবেশনায় বিমুগ্ধ দর্শক
রাস্তার পাশে জ্বালানি তেল বিক্রি নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ট
ট্রাম্পের হুমকি: বিবিসির বিরুদ্ধে ১০০ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা
আচরণবিধি ভাঙলে প্রার্থিতা বাতিল, গেজেট প্রকাশ ইসির
সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও সাড়ে ৪ মাস বাড়ল
রোহিঙ্গাদের মাঝে বৈধ সিম বিতরণ শুরু, প্রথম ধাপে ১০ হাজার
ইসলামী ৮ দলের যৌথ সমাবেশ : পাঁচ দফা দাবিতে পল্টন মোড়ে নেতাকর্মীরা
দুই ঘণ্টা পর ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক
ছাত্রলীগ নেতাকে অপহরণে আপ এর দায় স্বীকার, ৩ কর্মী বহিষ্কার
ফেব্রয়ারির কবে নির্বাচন, জানালেন প্রেস সচিব
নায়ক নয়, সবাই আমাকে প্রোডাক্ট বানিয়েছিল:প্রসেনজিৎ
ভারতের নারী ক্রিকেট দলে প্রথম বিদেশি ফিটনেস কোচ!
বুকার পুরস্কার জিতলেন হাঙ্গেরীয়-ব্রিটিশ লেখক ডেভিড সা-লাই
জুলাই সনদের বাইরে সরকারের সিদ্ধান্তের দায় নেবে না বিএনপি
১৩ নভেম্বর ঘিরে শক্ত অবস্থানে সরকার
শীতের আমেজ: আরও দুই ডিগ্রি নামার আশঙ্কা
সাত গোলের দাপটে শেষ ষোলোয় আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব–১৭ দল
হাসপাতাল থেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে অপহরণ, গ্রেপ্তার ৩