ফার্মগেটে পথচারীর মৃত্যু ও নিরাপত্তা সংকট
প্রকাশ: ১৯:২৩, ২৬ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৯:৫৫, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
আহমেদ রাজু
ঢাকার ফার্মগেট—শহরের এক প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন এখানে হাজারো মানুষ অফিস, স্কুল, বাজার এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যে চলাচল করেন। কিন্তু রোববার দুপুরে এই ব্যস্ত এলাকা মর্মান্তিকভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়। মেট্রোরেলের একটি পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে পথচারী আবুল কালাম (৩৫) প্রাণ হারান।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা আবুল কালামের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি আমাদের শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মুহূর্তের মধ্যে চিৎকার ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মেট্রোরেলের চলাচল বন্ধ করা হয়, যা প্রায় আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী ছিল।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২৬ অক্টোবর ২০২৫, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলারের নিচে বসানো বিয়ারিং প্যাডটি খুলে পড়ে আবুল কালামের মাথার ওপর। মুহূর্তেই তিনি প্রাণ হারান। এলাকাবাসী এবং যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শহরের ব্যস্ততম রুটের এই থমকে থাকা মুহূর্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সুন্দর শহরের ভেতরও লুকিয়ে আছে বিপদ।
ফার্মগেটে এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর একটি বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ায় মেট্রোরেলের চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে সে ঘটনায় তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ও পদক্ষেপ সীমিত ছিল। আজকের দুর্ঘটনা প্রমাণ করে, সঠিক পুনঃমূল্যায়ন ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বিপদের পুনরাবৃত্তি হয়। ফার্মগেট শুধু একটি এলাকা নয়, এটি রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাতায়াত পথগুলোর একটি। এখানে কোনো দুর্ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণ নয়, পুরো শহরের জন্য বিপজ্জনক। একটি অবহেলিত অংশ, একটি ত্রুটি—মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে।
মেট্রোরেলের উড়ালপথের বিয়ারিং প্যাডগুলোর ওজন প্রায় ১৫০ কেজি। এগুলো ট্রেনের ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। তবে, এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ বারবার দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি প্রমাণ করে, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি কতটা মারাত্মক হতে পারে। তাই শুধু প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও জরুরি। নিয়মিত পরিদর্শন, মান নিয়ন্ত্রণ, ত্রুটিপূর্ণ উপাদান দ্রুত সংশোধন—এগুলো ছাড়া শহরের অবকাঠামোকে নিরাপদে রাখা সম্ভব নয়।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেয়। এটি প্রশংসনীয়। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। প্রতিটি পিলারের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত করা, ক্ষতিগ্রস্ত বা ত্রুটিপূর্ণ উপাদান দ্রুত পরিবর্তন, জনসাধারণকে সতর্ক করা, জরুরি পরিস্থিতিতে তৎক্ষণাৎ সাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করা, শুধু প্রতিক্রিয়া নয়; আমাদের উচিত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে আর কোনো প্রাণহানি না ঘটে।
নিহত আবুল কালামের পরিবার শোকে নিমজ্জিত। সরকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে, তবে তার পরিবারকে মাত্র ৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের মানসিক ক্ষতি পূরণ হবে না। মানুষের জীবনকে কোনো আর্থিক হিসাবের সঙ্গে মাপা যায় না। এই ঘটনায় সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রবল। ফেসবুক, এক্স (আগের টুইটার), সংবাদমাধ্যম—সব জায়গায় প্রশ্ন উঠছে, ‘শহরের নিরাপত্তা কতোটা কার্যকর?’, ‘আবার এমন ঘটনা কি হবে না?’। মানুষ উদ্বিগ্ন, এবং সেই উদ্বেগ প্রশাসনকে সতর্ক বার্তা দিচ্ছে। একইসঙ্গে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে, অবকাঠামো উন্নয়ন কেবল প্রযুক্তি বা নির্মাণমানের ওপর নির্ভর করে না; মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেতে হবে।
এই ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো—গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের নিয়মিত পরিদর্শন। ত্রুটিপূর্ণ নকশা বা উপাদান শনাক্ত হলে তা অবিলম্বে সংশোধন।জনসাধারণকে বিপজ্জনক এলাকায় সতর্ক করা। জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
এই দুর্ঘটনা শুধু একটি মৃতদেহের গল্প নয়; এটি মনে করিয়ে দেয়, শহরের নিরাপত্তা ও মানুষের জীবনরক্ষা করা কতটা জরুরি। এখন সময় এসেছে, শুধু প্রতিক্রিয়া নয়; কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। নিশ্চিত করতে হবে—আর কোনো আবুল কালামের জীবন যেন চলে না যায়। এই ঘটনা সকলকে সতর্ক করছে, শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনই পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার পরিণতি ও ফলাফলের জন্য আমরা প্রস্তুত কি-না তা এখনই ভাবা জরুরি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
ই-মেইল: razu75bd@gmail.com
