আমরা যুদ্ধে বাঁচলেও যুদ্ধবিরতিতে হয়তো বাঁচব না
প্রকাশ: ২১:২৭, ২৫ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০০:২৫, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
সারা আওয়াদ
গত রবিবার (১৯ অক্টেবর) সকালে আমি গাজা উপত্যকার মধ্যাঞ্চলীয় এলাকা আজ-জাওয়াইদার তাঁবু থেকে বের হই। যুদ্ধবিরতির ১০ দিন পার হয়েছে। ভাবলাম, এবার হয়তো বাইরে যাওয়া নিরাপদ। কাছেই ‘টুইক্স ক্যাফে’ নামে একটি কোওয়ার্কিং স্পেস আছে, যা ফ্রিল্যান্সার ও শিক্ষার্থীদের ছোট্ট আশ্রয়স্থল। সেখানে একটু বসে কাজ করব। মনে হয়েছিল, এভাবে হয়তো আগের জীবন কিছুটা ফিরে পাওয়া যাবে।
আমি ও আমার ভাই ঠিক ক্যাফের কাছে পৌঁছেছি, এমন সময় হঠাৎ পরিচিত এক ভয়াল শব্দ কানে এলো, বিস্ফোরণের গর্জন। ইসরায়েলি একটি ড্রোন টুইক্স ক্যাফের প্রবেশপথে আঘাত হেনেছে।
আমি স্থির হয়ে গেলাম। মনে হলো, এটাই হয়তো আমার শেষ মুহূর্ত। তিনজন মারা গেছে, আহত হয়েছে আরও অনেকে। আমরা যদি কয়েক মিনিট আগে বের হতাম, তাহলে হয়তো আমাদের নামও নিহতদের তালিকায় থাকত। আরও ভাবলাম, আমরা যুদ্ধ চলাকলীন বাঁচলেও যুদ্ধবিরতিতে হয়তো বাঁচতে পারব না।
খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই পরিবারে হাহাকার শুরু হলো। মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল ছিল, মা আমাদের বারবার ফোন করেও পাচ্ছিলেন না। তাকে নিশ্চিন্ত করতে পারলাম কেবল তাঁবুতে ফিরে গিয়ে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এ কেমন যুদ্ধবিরতি? ভয়ের চেয়ে ক্ষোভই তখন বেশি অনুভব করছিলাম।
যখন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন অনেকে মনে করেছিল, অবশেষে বোমা পড়া বন্ধ হবে। আমরা নতুন করে জীবন গড়তে পারব। কিন্তু ইসরায়েলি দখলের নিচে আশা বলে কিছু থাকে না। সহিংসতা কখনো থামে না। যেদিন টুইক্স ক্যাফেতে হামলা হয়, সেদিনই গাজার বিভিন্ন স্থানে আরও ডজনখানেক জায়গায় বোমা বর্ষণ হয়। নিহত হয় অন্তত ৪৫ জন, আহত অসংখ্য।
এটাই ছিল যুদ্ধবিরতির পর সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। তারপর থেকে একদিনও এমন যায়নি, যেদিন কেউ নিহত হয়নি। যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরও এখন পর্যন্ত শতাধিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। তাদের মধ্যে ছিল আবু শাবান পরিবারের ১১ জন সদস্য। ১৮ অক্টোবর তারা গাজা সিটির জায়তুন পাড়ায় নিজেদের বাড়িতে ফিরছিল। একটি গাড়িতে ছিল সবাই। হঠাৎ ইসরায়েলি বোমা সেই গাড়িকে চূর্ণ করে দেয়।
ইসরায়েল একেই বলে ‘যুদ্ধবিরতি’।
রবিবারের ওই ভয়াবহ বোমাবর্ষণের পর গোটা গাজায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের শব্দ চলতেই থাকে। মানুষ ছুটে যায় বাজারে, যা কিছু খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায়, যতটুকু সম্ভব কিনে রাখে। সবাই জানে, যুদ্ধ ও অনাহার আবার শুরু হবে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল মানুষের সেই তাড়না, বোমা পড়ছে, কিন্তু সবাই ব্যস্ত আগামী দিনের খাবার নিয়ে। নিরাপত্তাবোধ যেন চিরতরে হারিয়ে গেছে। জানি না, আগামীকাল আমাদের টেবিলে খাবার থাকবে কি না।
ইসরায়েল শুধু বোমা বর্ষণেই থেমে নেই, সাহায্যও আটকে দিয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ৬০০টি সাহায্যবাহী ট্রাক গাজায় ঢোকার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢুকতে পেরেছে মাত্র ৯৮৬টি ট্রাক, প্রতিশ্রুতির মাত্র ১৫ শতাংশ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) হিসাবে, তাদের ৫৩০টি ট্রাক ঢোকার অনুমতি পেয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ’র ৬০০০ ট্রাক এখনো সীমান্তে অপেক্ষায়, একটিও ঢুকতে পারেনি। ডব্লিউএফপির এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, গাজা সিটিতে কোনো বড় সাহায্য কাফেলা ঢোকার অনুমতি এখনো পায়নি। ইসরায়েল এখনো সালাহউদ্দিন সড়ক ব্যবহারের অনুমতি দেয় না। উত্তর গাজায় অনাহারের নীতি কার্যত বহাল রেখেছে তারা।
মিসরের সঙ্গে একমাত্র সীমান্ত রাফা ক্রসিং এখনো বন্ধ। কেউ জানে না কবে খুলবে। কবে আহতদের বিদেশে চিকিৎসার জন্য নেওয়া যাবে, কবে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় ফিরবে, কবে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলো এক হবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
সবাই বুঝে গেছে, ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতিকে খেলনা বানিয়েছে। ইচ্ছে মতো কখনো চালু, কখনো বন্ধ করছে। একদিন ভয়াবহ বোমাবর্ষণ, পরদিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা। যেন কিছুই ঘটেনি, যেন ৪৫টি প্রাণ চলে যায়নি, কোনো ঘর ভাঙেনি, কোনো পরিবার ধ্বংস হয়নি।
আমাদের জীবন যেন তাদের কাছে কিছুই নয়। একের পর এক হত্যাযজ্ঞের মাঝেও বিশ্ব নীরব। ইসরায়েল চাইলে যেকোনো সময় আবার হত্যাযজ্ঞ শুরু করতে পারে কোনো অজুহাত ছাড়াই।
এই যুদ্ধবিরতি আসলে এক অন্তহীন যুদ্ধের মধ্যবর্তী ক্ষণিক বিরতি, নিঃশব্দ বিরামচিহ্ন, যা যেকোনো সময় মুছে যেতে পারে। যতদিন বিশ্ব আমাদের বাঁচার অধিকার স্বীকার না করছে, ততদিন খবরের শিরোনামে আমরা শুধু সংখ্যা হয়ে থাকব।
লেখক: সারা আওয়াদ, গাজাভিত্তিক লেখক ও ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী
আল-জাজিরা থেকে ভাষান্তর–মাইসারা জান্নাত
