সাফল্যের পারমাণবিক মডেল অর্থনীতিতে এবার প্রয়োজন
প্রকাশ: ০০:০৫, ২৪ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০১:০২, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
আহসান ইকবাল। ছবি: সংগৃহীত
১৯৯৮ সালের ২৮ মে পাকিস্তান যা করেছিল, তা পৃথিবীর কেউই কল্পনা করেনি। চাগাইয়ের বন্ধুর পাহাড়ে আমরা প্রবেশ করেছিলাম বিশ্বের অভিজাত পারমাণবিক ক্লাবের সদস্যপদে। এটি শুধু বৈজ্ঞানিক বিজয় ছিল না, বরং ছিল ইচ্ছাশক্তি, শৃঙ্খলা ও জাতীয় উদ্দেশ্যের এক অদম্য জয়ের প্রতীক।
সেই ঐতিহাসিক পারমাণবিক পরীক্ষার কিছুদিন পর আমি পাকিস্তানের দুই বিজ্ঞানী— ড. আবদুল কাদির খান (কাহুটা) এবং ড. ইশফাক আহমদ (পিএইসি)—এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমি তাদের এক প্রশ্ন করেছিলাম, যা বহুদিন ধরে আমার মনে ছিল। এমন কী ছিল সেই গোপন সূত্র, যার মাধ্যমে পাকিস্তান এমন এক কৃতিত্ব অর্জন করল, যা বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো ঠেকাতে চেয়েছিল?
আমরা তখন নিষেধাজ্ঞার মুখে, প্রযুক্তিগত বঞ্চনা ও সম্পদের ঘাটতিতে ভুগছিলাম। বৈশ্বিক শক্তির কাঠামো আমাদের বিপক্ষে ছিল। তবুও আমরা সফল হয়েছিলাম—অথচ এমন অনেক ক্ষেত্রে, যেখানে বিশ্ব সাহায্য করতে প্রস্তুত এবং সম্পদও ছিল, সেখানে আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। কেন? তাদের উত্তর আজও আমার মনে অমলিন। তারা বলেছিলেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক সাফল্য কোনো দুর্ঘটনা নয়; এটি ছিল এক বিশেষ ব্যবস্থাপনা দর্শনের ফল—উৎকর্ষ, যোগ্যতা, শৃঙ্খলা ও যৌথ জাতীয় উদ্দেশ্যের সংস্কৃতি।
এই একই দর্শন যদি আমাদের অন্য খাতে প্রয়োগ করা যায়, তবে পাকিস্তান আবারও রূপান্তরিত হতে পারে। এটি আমাদের নিজস্ব ‘সাফল্যের পারমাণবিক মডেল’। এটি সময়ের ঊর্ধ্বে, আমাদের নিজস্ব রূপরেখা, যা অসম্ভবকে সম্ভব করার পথ দেখায়। এই মডেলই হতে পারে আমাদের পরবর্তী জাতীয় মিশন ‘উড়ান পাকিস্তান’-এর দিকনির্দেশনা—২০৩৫ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা।
এই মডেলের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো
১. একক দৃষ্টি ও উদ্দেশ্য
পারমাণবিক কর্মসূচি মেশিন বা অর্থের ওপর নয়, বরং এক যৌথ দৃষ্টি ও মিশনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঝাড়ুদার থেকে প্রধান বিজ্ঞানী পর্যন্ত—সবাই জানতেন, তাদের লক্ষ্য একটাই; পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা শক্তিকে অবিনাশী, দৃঢ় ও আত্মনির্ভর করা। এই ঐক্যই সাধারণ মানুষকে অসাধারণ কর্মী বানিয়েছিল, সৃষ্টি করেছিল উৎকর্ষের পরিবেশ।
আজ পাকিস্তানকে সেই একই ঐক্যবোধ পুনরুদ্ধার করতে হবে—তবে এবার অর্থনৈতিক শক্তির জন্য। ‘উড়ান পাকিস্তান’-এর লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটি নাগরিকের নিজস্ব মিশন। সরকার, উদ্যোক্তা, তরুণ ও নীতিনির্ধারক—সবাইকে বুঝতে হবে, দেশের উন্নয়নই তাদের নিজস্ব দায়িত্ব।
২. নেতৃত্বের স্থিতিশীলতা
পারমাণবিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক চেয়ারম্যান অন্তত ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই ধারাবাহিকতা আস্থা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সাফল্য নিশ্চিত করেছিল।
ড. এ কিউ খান একবার বলেছিলেন—“যদি আমাদের চেয়ারম্যানরা প্রধানমন্ত্রীদের মতো বারবার বদলাতেন, তাহলে আমরা পারমাণবিক বোমা নয়, আতশবাজি বানাতাম।”
এ থেকে গভীর শিক্ষা নেওয়ার আছে। সফল দেশগুলো নেতৃত্বের স্থিতিশীলতাকে সম্পদ হিসেবে দেখে—মালয়েশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়া—সবার ক্ষেত্রেই ধারাবাহিক নেতৃত্ব সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ছিল।
৩. যোগ্যতাই একমাত্র মানদণ্ড
পারমাণবিক কর্মসূচিতে কোনো ‘সিফারিশ’ বা তদবির ছিল না। নিয়োগ, পদোন্নতি ও দায়িত্ব—সবই যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। সেখানে উৎকর্ষই ছিল অগ্রগতির একমাত্র মুদ্রা। অথচ আজ আমাদের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান তদবির ও পক্ষপাতিত্বে জর্জরিত। যদি আমরা সত্যিই উন্নয়ন চাই, তবে যোগ্যতাকেই জাতীয় ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে—শ্রেণিকক্ষ থেকে বোর্ডরুম পর্যন্ত।
৪. মানবসম্পদে বিনিয়োগ
সাফল্যের মূল শক্তি ছিল মানুষ—বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, কারিগর। তারা প্রশিক্ষিত ও সক্ষম ছিলেন। প্রতিষ্ঠানগুলো মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছিল, বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, গবেষণায় উৎসাহ দিয়েছিল।
আজ পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তির ওপর। দেশের ২৪ কোটি মানুষের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ৩০ বছরের নিচে— এটাই আমাদের প্রকৃত ‘পারমাণবিক শক্তি’। যদি আমরা তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করি, তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগে পাকিস্তানকে এগিয়ে নিতে পারবে।
৫. পর্যাপ্ত সম্পদের সরবরাহ
অর্থনৈতিক সংকট থাকা সত্ত্বেও, রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছিল যাতে পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব না হয়। কারণ এটি ছিল জাতীয় অগ্রাধিকার। উন্নয়নের ক্ষেত্রেও একইভাবে বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। বর্তমানে পাকিস্তান শিক্ষা ও গবেষণায় মিলিয়ে জিডিপির মাত্র ২% ব্যয় করে—এটি পরিবর্তন না করলে ‘অর্থনৈতিক চাগাই’ কখনো ঘটবে না।
৬. কার্যকর স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা
পারমাণবিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত। তারা প্রতিদিনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জড়ায়নি। এই স্বাধীনতাই সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনকে উন্মুক্ত করেছিল। আজকের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সেইভাবে স্বাধীনতা ও আস্থার পরিবেশ দিতে হবে, যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত ও উদ্ভাবন সম্ভব হয়।
জ্ঞানে নয়, সংস্কৃতিতে রূপান্তর
সাফল্যের পারমাণবিক মডেল কেবল এক ব্যবস্থাপনা দর্শন নয়, বরং জাতীয় বিশ্বাসের গল্প। এটি প্রমাণ করে, নিঃসঙ্গতা ও চাপের মধ্যেও একটি দৃঢ় জাতি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। ১৯৯৮ সালে আমরা ছিলাম আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে—তবুও সাফল্য পেয়েছিলাম। আজ কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তবুও আমরা স্থবির। সমস্যাটা ক্ষমতার নয়, সমন্বয়ের; জ্ঞানের নয়, সংস্কৃতির।
এই মডেল আমাদের শেখায়—সাফল্য আসে সেই ব্যবস্থা থেকে, যা যোগ্যতাকে পুরস্কৃত করে, স্থিতিশীলতা দেয়, এবং উদ্দেশ্যকে একত্রিত করে। যদি আমরা এই মডেলকে শাসনব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে প্রয়োগ করতে পারি, তবে পাকিস্তান আবারও এক ‘চমকপ্রদ বিস্ময়’ ঘটাতে পারবে—এবার অস্ত্র নয়, সমৃদ্ধি গড়ে।
১৯৯৮ সালের প্রজন্মের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আজকের প্রজন্মের দায়িত্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। আসুন, চাগাইয়ের ঐক্যকে রূপ দিই বাজারের শৃঙ্খলায়, ল্যাবের উদ্ভাবনে, শ্রেণিকক্ষের উৎকর্ষে। আসুন, পারমাণবিক গর্বকে রূপান্তর করি উন্নয়নের স্পৃহায়—নতুন অভিযাত্রার জন্য, ‘মারকা-এ-তারাক্কি’।
যে বিজ্ঞানীরা ১৯৯৮-এ জ্ঞান ও দৃঢ়তার মাধ্যমে আমাদের অজেয় করেছিলেন, আজকের তরুণরাও সেই একই সূত্রে পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করতে পারে। এখন সময় এসেছে সেই সাফল্যের পারমাণবিক মডেল আবার প্রয়োগ করার—এবার অস্ত্র নয়, বরং সম্পদ, কল্যাণ ও এক জয়ী জাতি গঠনের জন্য।
লেখক: পাকিস্তানের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও বিশেষ উদ্যোগ বিষয়ক মন্ত্রী
* মূল লেখা: আহসান ইকবালের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেল থেকে নেওয়া।
