দিল্লির ‘বাবা’ থেকে রাম রহিম, আসারাম
ভারতের অবিরাম গডম্যান মোহ
ভারতী মিশ্র নাথ
প্রকাশ: ১৮:২৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

২০২৫ সালে এসে, প্রায় এক দশক পরও যখন স্বঘোষিত গডম্যান আসুমল সিরুমালানি হারপালানি ওরফে আসারাম বাপুকে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তখনো গুজরাটের সুরাট নিউ সিভিল হাসপাতালে কিছু কর্মচারীকে তার উদ্দেশে প্রার্থনা করতে দেখা গেছে—এ দৃশ্য একইসঙ্গে অস্বস্তিকর ও তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে একজন নিরাপত্তারক্ষী এবং একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়।
দিল্লিতেও একই চিত্র—সেখানে পুলিশ খুঁজছে চৈতন্যনন্দ সরস্বতীকে, যিনি একটি ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত। ভুক্তভোগীদের একাধিক অভিযোগ এবং বিমান বাহিনীর একটি চিঠির পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। তারপর থেকেই তিনি পলাতক।
‘পূজিত অপরাধী’
আসারাম ২০১৩ সালের আগস্ট থেকে কারাগারে আছেন, যখন তিনি উত্তরপ্রদেশের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হন। এর দুই মাস পর, অক্টোবর ২০১৩-তে তিনি ও তার ছেলে নারায়ণ সাই সুরাটের আশ্রমে দুই বোনকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।
বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ, ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য এবং দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে দণ্ডিত হলেও আসারামের জনপ্রিয়তায় বিশেষ ভাটা পড়েনি—বিশেষ করে গুজরাটে, তার নিজ রাজ্যে। এমনকি জেলে থাকার সময়ও প্রভাব এতটাই ছিল যে মামলার সাক্ষীদের ওপর হামলা হয়েছে বা তারা নিখোঁজ হয়েছে। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারাও হুমকির মুখে পড়েছিলেন। রাজনৈতিক আশ্রয় ও অনুসারীদের শক্তির জোরে আসারাম এবং তার ছেলে বহুদিন ধরে বিচারের হাত এড়িয়ে ছিলেন। নারায়ণ সাই-ও ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত।
একইভাবে ডেরা সাচা সৌদার প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিং, যিনি দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন, তিনি ‘প্যারোল’ নেবার কৌশলে সিদ্ধহস্ত। সর্বশেষ ৫ আগস্ট তাকে ৪০ দিনের প্যারোল দেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের গডম্যানদের লাখো ভক্ত ও বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। অনুসারীদের অন্ধ বিশ্বাস তাদের হাতে এক ধরনের নৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব এনে দেয়, যা রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে আরও শক্তিশালী হয়। আবার রাজনীতিকরা ভোটব্যাংকের আশায় তাদের পাশে দাঁড়ান।
বিশ্বাস যখন বিপজ্জনক হয়
ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অধিকার। কিন্তু যখন এই বিশ্বাস সত্য ও ন্যায়ের বিচারকে ঢেকে দেয়, তখন তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। যখন চিকিৎসাকর্মীরা—যাদের দায়িত্ব বিজ্ঞান, নীতি ও জনসেবার মূল্যবোধ রক্ষা করা—একজন দোষী সাব্যস্ত ধর্ষককে প্রকাশ্যে সম্মান জানায়, তখন তা নৈতিকতা ও নাগরিক কর্তব্য থেকে ভয়ংকর বিচ্ছিন্নতার চিত্র তুলে ধরে।
এটি শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়। যখন সরকারি কর্মচারীরা অপরাধীদের পূজা করেন, তখন সমাজে এক ধরণের বার্তা যায় যে আধ্যাত্মিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা আইন থেকে ঊর্ধ্বে।
সুরাট সিভিল হাসপাতালের ঘটনাটিতে রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার বলেছেন, “আমাদের এক কর্মী ফোন করে জানায় যে আসারামের অনুসারীরা রোগীদের ফল বিতরণ করতে চায়। আমরা সে অনুমতি দিয়েছিলাম। তবে ছবি টানানো বা পূজার কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি।” তবু এখনো কোনো তদন্ত হয়নি।
দ্বৈত মানদণ্ড
প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কোনো কর্মচারী হাসপাতালে কোনো সন্ত্রাসী বা সাধারণ খুনিকে প্রশংসা করতেন, তবে কি একই প্রতিক্রিয়া হতো? নিশ্চয়ই না। তবে কেন গডম্যানদের ক্ষেত্রে এমন সহানুভূতি?
আসারামের মতো বিতর্কিত চরিত্রের প্রতি জনসাধারণের অন্ধ সমর্থন আমাদের সমাজের গভীর অসুস্থতার লক্ষণ—যেখানে অনুসারীরা নিজেদের বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে চান না, এমনকি তা ধ্বংসাত্মক হলেও।
সুরাট সিভিল হাসপাতালের ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে স্থানীয় মনে হলেও, আসলে এটি ভারতের একটি বড় সমস্যার প্রতিফলন। এটি কেবল বিচারের ভুল নয়—এটি প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতার ব্যর্থতা। আর কর্তৃপক্ষের নীরবতা এ ধরনের কাজকে আরও স্বাভাবিক করে তুলবে।
লেখাটি এনডিটিভির মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে
লেখক: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, এনডিটিভি)
এটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত