সিএনএনের ব্যাখ্যা
চীন কি অবশেষে পারমাণবিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিল?
প্রকাশ: ১৬:৩৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেইজিং সামরিক কুচকাওয়াজে সবচেয়ে বেশি কূটনৈতিক লাভ কুড়িয়েছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। একদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং অন্যদিকে শির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে কিম বিশ্বকে দেখিয়েছেন— তিনি বিশ্বের দুই প্রভাবশালী স্বৈরশাসকের সমর্থন ভোগ করছেন এবং তারা একসঙ্গে পশ্চিমা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তুলছেন।
প্যারেডের আড়ালে কিম আরও একবার পুতিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন করেন। পুতিন প্রতিশ্রুতি দেন যে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে লড়তে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের আত্মত্যাগ তিনি “কখনো ভুলবেন না”। পাশাপাশি, ছয় বছর পর শির সঙ্গে কিমের প্রথম শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা মস্কোর সঙ্গে পিয়ংইয়ংয়ের সামরিক জোট ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত চীন-উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করে।
সবশেষে শি ব্যক্তিগতভাবে ঝংনানহাইয়ের বাসভবনে কিমকে চা এবং ভোজে আমন্ত্রণ জানান— যেখানে বাকি ২৬ বিদেশি অতিথির মধ্যে কেবল পুতিনই প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন। এক তরুণ নেতা হিসেবে যিনি দীর্ঘদিন বেইজিং এবং মস্কোর কাছে গৌণ ভূমিকায় বিবেচিত হয়েছেন, তার জন্য এই সম্মান নিঃসন্দেহে বড় প্রচারণা সাফল্য।
তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে আনুষ্ঠানিক নীরবতায়। শি–কিম বৈঠকের সরকারি বিবরণীতে প্রথমবারের মতো “কোরীয় উপদ্বীপের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ”-এর কোনো উল্লেখ ছিল না। ২০১৮–২০১৯ সালের পাঁচটি বৈঠকের প্রতিটিতেই এটি আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল।
কার্নেগি এনডাউমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো তং ঝাও বলেন, “এই লক্ষ্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে চীনের দীর্ঘমেয়াদি নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিশ্চিত হলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিন্তু স্পষ্টভাবে, উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র একটি পারমাণবিক-মুক্ত কোরীয় উপদ্বীপের প্রচেষ্টা ত্যাগ করেছে।”
উত্তর কোরিয়ার আত্মবিশ্বাস
বেইজিং সফরের পরপরই কিম নতুন উচ্চ-ক্ষমতার রকেট ইঞ্জিন পরীক্ষা দেখেছেন, যা পিয়ংইয়ংয়ের নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ‘হোয়াসং-২০’ চালাতে ব্যবহৃত হবে।
সিউলের কিয়ংনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিম ইউল-চুল মন্তব্য করেছেন, “চীন–উত্তর কোরিয়ার যৌথ বিবৃতিতে নিরস্ত্রীকরণের কোনো উল্লেখ না থাকায় কিম তার পারমাণবিক শক্তি ধরে রাখার যৌক্তিকতা পেয়েছেন।”
এদিকে সিউলের নর্থ কোরিয়ান স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াং মুজিন বলেছেন, “বেইজিং প্যারেড থেকে সবচেয়ে বড় বিজয়ী কিম জং উন। তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা বেড়েছে এবং চীনের সঙ্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় কাজে লাগানো যাবে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও কিমের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে জড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন, যদিও প্রথম মেয়াদে তার নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির চেষ্টা ভেস্তে যায়। তবে এখন ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কাতারে হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলার মতো একাধিক পররাষ্ট্র নীতির সংকটে জর্জরিত।
চীনের অবস্থান পরিবর্তন
চীন এতদিন উত্তর কোরিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক ভরসা এবং পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার অংশীদার ছিল। এমনকি জাতিসংঘেও বহুবার নিষেধাজ্ঞা আরোপে ভোট দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র–চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেইজিংয়ের সহযোগিতা কমে এসেছে। একইভাবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে পিয়ংইয়ংকে সামরিকভাবে আরও খোলামেলাভাবে সমর্থন দিচ্ছে।
২০২২ সালে চীন ও রাশিয়া একসঙ্গে উত্তর কোরিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কারণে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন নতুন নিষেধাজ্ঞা ভেটো করে। এরপর থেকে চীন আর কোনো সরকারি বিবৃতিতে নিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
রাশিয়া এখন প্রকাশ্যে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে সমর্থন করছে। গত বছর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ বলেছিলেন, নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্ন “বন্ধ বিষয়” এবং উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষার মূলভিত্তি হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মস্কো বোঝে।
কৌশলগত ইঙ্গিত ও আশঙ্কা
বিশ্লেষক উ চিয়াং মন্তব্য করেছেন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক মর্যাদাকে গ্রহণ করা হয়তো শি ও পুতিনের নতুন বিশ্বব্যবস্থার কৌশলের অংশ। “যতক্ষণ বর্তমান শৃঙ্খলা দুর্বল করা চীনের লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করে, ততক্ষণ বেইজিং হয়তো পিয়ংইয়ংকে আড়াল করবে,” তিনি বলেন।
এতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান পারমাণবিক কর্মসূচি বিবেচনা করতে পারে— বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক ছাতার ওপর আস্থা কমছে।
তং ঝাও সতর্ক করেছেন, “চীনের এই নীরব স্বীকৃতি এক ধরনের বিপজ্জনক বার্তা দিচ্ছে। এটি অন্য দেশগুলোকেও উৎসাহিত করতে পারে, যারা বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নিজেদের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজে লাগাতে চাইবে।”