বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫

| ৬ কার্তিক ১৪৩২

আলতাফরা প্রদীপের নিচে অন্ধকার

আহমেদ রাজু

প্রকাশ: ২০:৩০, ২১ অক্টোবর ২০২৫

আলতাফরা প্রদীপের নিচে অন্ধকার

গেল কয়েকদিন ধরে সদ্য চালু হওয়া অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ঢাকা স্ট্রিমের গ্রাফিক্স ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যু নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন আলোচনার এটাই প্রধান ইস্যু। 

পুলিশ ও স্বর্ণময়ীর আত্মীয়স্বজনের ধারণা, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। খবরে প্রকাশ, তার এই মৃত্যুর জন্য দায়ী ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজ। কারণ ১৩ জুলাই স্বর্ণময়ীসহ ওই প্রতিষ্ঠানের ২৬ কর্মী তার দ্বারা যৌন নিপীড়ন, বাজে ব্যবহার ও তার অপেশাদার আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিকার ও বিচার চেয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদের কাছে। 

কিন্তু তিনি (ইফতেখার মাহমুদ) অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেনইনি, উল্টো অভিযোগকারী কর্মীদের মধ্যে তিনজনকে গত ৯ সেপ্টেম্বর চাকরির মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা দারুণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। 

প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে  ইফতেখার মাহমুদ যদি তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যাটি সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতেন, তবে হয়তো স্বর্ণময়ীর প্রাণ সংহার না-ও হতে পারতো। তাই তার (স্বর্ণময়ী) আত্মহত্যার প্ররোচণার অভিযোগ থেকে ইফতেখার মাহমুদও দায় এড়াতে পারেন না। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, আলতাফ শাহনেওয়াজ একজন ভয়াবহ যৌন নিপীড়ক ও যৌন বীকারগ্রস্ত ব্যক্তি। তিনি নারী সহকর্মীদের সাথে যেমন আচরণ করেন, তা কোনো সভ্য ও শিক্ষিত মানুষ চিন্তাও করতে পারেন না। কিন্তু তিনি প্রতিনিয়ত নারী সহকর্মীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়ে গেছেন। এবং অফিসের সবাই তার এই আচরণ জানতেন। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করতেন না। শেষে তার অত্যাচারের মাত্রা এতোটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে, চাকরি হারানোর ঝুঁকি নিয়েই ৭ নারী কর্মীসহ ওই ২৬ জন তার বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগ এনে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। যদিও সেই অভিযোগ কাজে লাগেনি। তিন মাস ধরে ফাইল বন্দি ছিলো। 

নারী সহকর্মীদের ওপর আলতাফের যৌন নির্যাতনের ভাষা অত্যন্ত নোংরা ও কদর্যপূর্ণ। স্বর্ণময়ীর স্তনের আকার নিয়ে আলতাফ প্রতিনিয়ত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। তিনি (আলতাফ) প্রায়ই বলতেন, 'স্বর্ণময়ীর বাংলা গোছানো না, ভচকানো। যে মেয়ের স্তনের আকৃতি ভচকানো, তার বাংলা তো ভচকানোই  হবে।'  

কী জঘন্য কথা! কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কি এমন নোংরা কথা বলতে পারে? আলতাফের কর্মকাণ্ড শুনে মনে হয়, তিনি জন্মগতভাবেই যৌন বীকারগ্রস্ত। এবং তার জন্মও সম্ভবত নর্দমার ভাগাড়ে।    

আলতাফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা নারীদের মধ্যে একজন জানিয়েছেন, বিনা কারণে আলতাফ শাহনেওয়াজ গভীর রাতে নারী কর্মীদের ফোন দিতেন। সিঁড়িতে মেয়েদের আলাদা ডেকে নিয়ে যৌন উত্তেজক কথা বলতেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে তার ইচ্ছের ইঙ্গিত দিতেন। তাদের জিজ্ঞেস করতেন, ছেলে বন্ধু আছে কি-না। থাকলেও সম্পর্ক কতোটা গভীর এবং তার সাথে কখনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি-না, জানতে চাইতেন। যৌক্তিক কারণ ছাড়াই মেয়েদেরকে তার কাছে ডেকে নিয়ে যৌন বিষয়ক রসালো আলাপ করতেন। একইসঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে চাকরিচ্যুতিরও ভয় দেখাতেন। কখনো কখনো নিউজরুমে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি ও গালিগালাজ করতেন।   

অভিযোগকারী ওই নারী কর্মী বলেন, আলতাফের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করার পর প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ একটি তদন্ত কমিটি করেছিলেন। তখন তিনি (ইফতেখার মাহমুদ) ওই ৭ নারী কর্মীর সাথে আলাদাভাবে কথা বলেন। এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আলতাফকে নিউজরুমে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। একইসঙ্গে এসব বিষয় বাইরে কারো কাছে না বলতেও তিনি নির্দেশ দেন। কিন্তু তিন মাস অতিবাহিত হলেও সেই তদন্ত এখনো শেষ হয়নি এবং  আলতাফের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থাও নেননি। বরং কয়েক দিন পরই আলতাফ নিউজরুমে আবারও খবরদারি শুরু করেন। সম্পাদক সবকিছু জানা সত্ত্বেও আলতাফের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

আলতাফ শাহনেওয়াজ স্বর্ণময়ীকে শারীরিকভাবে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন কি-না, তা কোনো গণমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়নি। কিন্তু তিনি যৌন নিপীড়নমূলক কথার মাধ্যমে স্বর্ণময়ীকে চরম অসম্মান করেছিলেন। আর সে কারণেই স্বর্ণময়ী আত্মহত্যা করতে প্রভাবিত হতে পারেন। এ বিষয়টি এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খতিয়ে দেখা জরুরি। 

এতে আলতাফ কিংবা দোষী যেই হোক, তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গণমাধ্যমে কর্মরত নারীদের উপর যৌন নির্যাতন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে আগামীতে আর কোনো আলতাফের মতো যৌন-নিপীড়ক সৃষ্টি হতে না পারে। 

গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। শুধু তাই নয়, এটি সমাজের আয়না। যে আয়নায় সবার ভালো-মন্দ এবং পাপকর্ম দৃশ্যমান হয়। তাই সাংবাদিকদের বলা হয়, জাতির বিবেক। সমাজের নানা দুর্নীতি-অনিয়ম, অসংগতি, অন্যায়-অবিচারের মধ্যেও একমাত্র সাংবাদিকরাই টিমটিম করে ন্যায়ের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাদের কারণেই সামান্য হলেও আইনের শাসন চালু আছে। কিন্তু আলতাফ শাহনেওয়াজরা সমাজকে অন্ধকারের দিকে টানছেন। 

আলতাফের মতো অসৎ ও লম্পটরা কখনো সমাজে ন্যায়ের প্রদীপ জ্বালান না। তারা সমাজের আলোকবর্তিকা নন, তারা এই সমাজের প্রদীপের নিচে অন্ধকার!

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন