এখন আমার বাচ্চাদের কি হবে, কালামের স্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:১১, ২৭ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০৩:৪৩, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতলে ছেলেকে নিয়ে আবুল কালামের স্ত্রী
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের খুলে পড়া বিয়ারিং প্যাডের আঘাতে মারা যাওয়া আবুল কালামের পরিবারের আহাজারিতে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। দুর্ঘটনার পরপরই কালামকে এই হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসরা জানান, তিনি ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।
খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া। সঙ্গে ছিল দুই শিশু সন্তান। রবিবার (২৬ অক্টোবর) বিকেলে মর্গের সামনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন পিয়া। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বামীর এই অকালে চলে যাওয়া।
ছেলেকে কোলে নিয়ে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আজকে (কালামকে) আমি বিদায় দিতে চাইনি। অফিসে যাওয়ার সময় দরজাও লাগাতে যাইনি। এখন আমার বাচ্চাদের কী হবে?’
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের লাইনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে ৩৫ বছর বয়সী আবুল কালামের ওপর। আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
নিহতের ভাগ্নে শাহাদাত মর্গের সামনে বলেন, আবুল কালাম ট্রাভেল এজেন্টে এয়ার টিকেট বিক্রির কাজ করতেন। তার তিন ও চার বছর বয়সী দুটো বাচ্চা রয়েছে; পরিবার নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। 
তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন বলেন, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনের ফুটপাত দিয়ে আবুল কালাম হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ওপর থেকে বিয়ারিং প্যাড পড়লে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
কম্পন প্রতিরোধের জন্য সেতু বা উড়াল সেতুতে ইলাস্টোমোরিক বিয়ারিং প্যাড বসানো থাকে। এ প্যাড নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি, যা পিয়ার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয়। কোনোটির ভেতরে কয়েক পরতে থাকে স্টিলের কাঠামো, আর ওপরে থাকে রাবার। এগুলো ওজনে অনেক ভারী হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ওই প্যাড পড়ে একজন মারা যাওয়ার পাশাপাশি ফুটপাতে একটি চায়ের দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর খামারবাড়ি এলাকায় মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। দ্বিতীয়বার রবিবার আরেকটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে মারা যান কালাম।
কী হবে অসহায় পরিবারের
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া চুকিয়ে আবুল কালাম ঢাকায় একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে করাজ করতেন। ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে তার। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় থাকতেন। কালামের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে।
তার স্বজনরা জানান, ব্যবসায়িক কাজে নিয়মিত ফার্মগেট এলাকায় যাতায়াত করতেন কালাম।
নিহতের চাচাতো ভাই আব্দুল গণি চোকদার বলেন, ‘সরকারের অবহেলার কারণে আমার ভাই মারা গেল। এখন তার পরিবারে দায়-দায়িত্ব কে নেবে?’
এ ঘটনায় আবুল কালামের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ দেওয়া হবে জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিবারের সব দায়-দায়িত্ব নেবে সরকার। পরিবারে কর্মক্ষম কোনো সদস্য থাকলে তাকে মেট্রোরেলে চাকরি দেবে সরকার।
মরদেহ নেওয়া হয় সিদ্ধিরগঞ্জে, দাফন গ্রামের বাড়িতে
রবিবার রাতে হাসপাতালের মর্গ থেকে কালামের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্বজনরা রাতেই লাশ সিদ্ধিরগঞ্জের আইলপাড়া এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে গোসল ও জানাজা শেষ করে রাতেই লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
নিহত আবুল কালামের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ঈশ্বর কাঠি গ্রামে। সেখানে সোমবার সকালেই তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন আবুল কালামের স্ত্রীর বড় ভাই মো. আরিফ হোসেন।
ঈশ্বরকাঠি গ্রামে শোকের ছায়া
কিশোর বয়সে বাবা–মাকে হারিয়েছিলেন আবুল কালাম। এরপর ভাই-বোনদের সংসারে বেড়ে ওঠেন। কঠোর পরিশ্রম করে সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে চেষ্টা করছিলেন। পরিবারের সেই প্রিয় মানুষটি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা গেলেন।
কালামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। তার এমন অকালমৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন ও গ্রামের মানুষেরা।
ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দারা জানায়, ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে আবুল কালাম। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে আবুল কালাম ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। ২০ বছর আগে তার বাবা ও মা মারা যায়। এরপর তিনি বড় হন বড় ভাই ও বোনদের কাছে।
এক মাস আগে আবুল কালাম শেষবারের মতো গ্রামে গিয়েছিল। আর রবিবার সেই গ্রামের মানুষ পেল তার মৃত্যুর খবর।
স্বজনরা জানান, সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় যান আবুল কালাম। সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে তাদের ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়েসন্তান রয়েছে। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় বসবাস করতেন। ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন। ওই কাজের জন্যই প্রতিদিন তিনি নারায়ণগঞ্জ–ঢাকা যাতায়াত করতেন।
তারা আরও জানান, প্রতিদিনের মতো রবিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে আসেন আবুল কালাম। এরপর কাজের জন্য সেখান থেকে বের হন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যায়। সেটির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান আবুল কালাম। এরপর গণমাধ্যমের সংবাদে পরিবারের সদস্যরা তার মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।
আবুল কালামের মৃত্যুর খবরে শোকার্ত ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দারা। কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামে থাকা তার স্বজনেরা। অনেকে ছুটে যান ঢাকায়।
আমাদের শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাড়িতে চার ভাইয়ের টিনের চারটি বসতঘর রয়েছে। গ্রামে এলে একটি ঘরে থাকতেন আবুল কালাম। সেই ঘরটি তালাবদ্ধ।
কালামের বড় ভাই খোকন চোকদার গ্রামের বাড়িতে থাকেন। পারিবারিক জমিজমা দেখাশোনা করেন। পারিবারিক সেসব জমিজমা ও ফসলাদির খোঁজ নেওয়ার জন্য গত মাসে আবুল কালাম গ্রামের বাড়িতে আসেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে কাজ সেরে আবার ঢাকায় ফিরে যান।
খোকন চোকদার বলেন, ‘ওটাই যে আমার ভাইয়ের শেষযাত্রা হবে, আমি বুঝতে পারিনি। এখন সে ফিরবে প্রাণহীন দেহ নিয়ে।’
