জুলাই সনদ
জুলাই সনদ—যৌক্তিক বাস্তবায়নের পথে নাকি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ফাঁদ
প্রকাশ: ০৮:১১, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে 'জুলাই সনদ' এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সরকার একে বলছে, রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন নীলনকশা, যার লক্ষ্য সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নাগরিক আস্থার পুনর্গঠন।
এই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ আজ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেবে ঐক্যমত্য কমিশন। এই সনদে এমন সব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যা শুনতে রূপান্তরমূলক মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পরিকল্পনা কতোটা বাস্তবমুখী, আর কতোটা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি?
সরকার বলছে, জুলাই সনদ তিনটি মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে—সুশাসন, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় ও কর্মসংস্থান। এসবের মাধ্যমে একটি আধুনিক দায়িত্বশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, এই পরিকল্পনা কার্যকর হলে দুর্নীতি কমবে, নাগরিক সেবা সহজ হবে এবং স্থানীয় সরকার আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু এসব ঘোষণার পেছনে যে প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন, তা এখনো দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যে কোনো নতুন নীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাস্তবায়ন।
প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক প্রভাব এবং জবাবদিহির অভাব প্রায়ই ভালো উদ্যোগগুলোকে ব্যর্থ করে দেয়। জুলাই সনদও সেই পরীক্ষার মুখোমুখি। এতে উচ্চাভিলাষ আছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কম। যেমন, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিশনের স্বাধীনতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কিভাবে সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে, তা অস্পষ্ট। আবার স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়নের কথা বলা হলেও কেন্দিয় নিয়ন্ত্রণের কাঠামো অটুট রয়ে গেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও রূপান্তরের সনদ নতুন কিছু নয়। ‘ভিশন ২০২১’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মপরিকল্পনা’, ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’—সবই দেশের উন্নয়নের উচ্চাভিলাষী রূপরেখা ছিলো। কিন্তু এসব পরিকল্পনার বড় অংশই কাগজে রয়ে গেছে। এখন তাই প্রশ্ন উঠছে, জুলাই সনদ কি সেই একই পথে হাঁটছে, নাকি এটি বাস্তবে নতুন কিছু ঘটাতে পারবে?
এই সনদের ইতিবাচক দিক হলো এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের কথা বলা হয়েছে। জনগণের অংশগ্রহণ, স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ ও নাগরিক মতামতের গুরুত্ব—এসব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে পরিকল্পনায়। কিন্তু বাস্তবে অংশগ্রহণ তখনই সম্ভব, যখন ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। বর্তমানে উপজেলা, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের সিদ্ধান্তও প্রায় সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের অনুমতির ওপর নির্ভরশীল। এই বাস্তবতায় 'জনগণকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা' কেবল একটি স্লোগান হিসেবেই রয়ে যায়।
শিক্ষা খাতেও জুলাই সনদের অঙ্গীকার বড়। বলা হয়েছে, শিক্ষা হবে দক্ষতানির্ভর, যা কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এটি প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে এখন যে সংকট চলছে, তার জন্য কেবল পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, এবং পাঠ্যক্রমের অনিশ্চয়তা এই খাতকে জর্জরিত করে রেখেছে। শিক্ষাকে কর্মবাজারের সঙ্গে যুক্ত করতে হলে দরকার বাস্তবভিত্তিক নীতি, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং বাজেটের পুনর্বিন্যাস। সনদে এসব বিষয়ে তেমন নির্দেশনা নেই।
কর্মসংস্থান বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশিয় উৎপাদন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে। এটি তরুণদের জন্য আশার কথা। কিন্তু এই পুনরুজ্জীবনের পেছনে প্রয়োজন আর্থিক প্রণোদনা, সহজ ঋণনীতি এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ—যা এখনো নিশ্চিত নয়। ব্যাংক খাতের অনিয়ম, সুদের চাপ এবং ঋণপ্রাপ্তির জটিলতা উদ্যোক্তা তৈরির পথে বড় বাধা হয়ে আছে। তাই এই সনদের প্রতিশ্রুতি তখনই অর্থবহ হবে, যখন এই বাস্তব প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা, রপ্তানি খাতের সংকট এবং বিদেশি বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাপে রেখেছে। এই বাস্তবতায় উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা কার্যকর করা কঠিন।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও নতুন বিনিয়োগ নীতি ছাড়া সনদের অনেক লক্ষ্যই বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ইতিহাস বলে, পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় তখনই, যখন তা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির সীমায় আটকে যায়। যদি জুলাই সনদকে সরকার কেবল একটি প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তবে এটি রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের বদলে রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আবার যদি এটি সত্যিকারের নীতি হয়ে ওঠে—যেখানে সব পক্ষের অংশগ্রহণ থাকবে—তবে এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কারের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে।
বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও জরুরি। প্রতিটি প্রকল্পের অগ্রগতি জনসমক্ষে প্রকাশ করা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়া এবং সরকারের কার্যক্রমে স্বাধীন মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। উন্নয়ন কেবল ঘোষণা নয়, বরং মানুষের জীবনে পরিবর্তনের প্রতিফলন—এই সত্যটাই জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সনদ তখনই সফল হবে, যখন এটি কাগজের সীমা পেরিয়ে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে। যখন গ্রামের কৃষক সহজে ঋণ পাবে, তরুণরা চাকরির সুযোগ পাবে, আর নাগরিকগণ প্রশাসনিক সেবা পাবে সময়মতো—তখনই বলা যাবে সনদ বাস্তবে সফল।
জুলাই সনদ একটি উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ। এটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন রাষ্ট্রকে নতুন আস্থা ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু সাফল্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে বাস্তব প্রয়োগে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনগণের অংশগ্রহণ—এই তিনটি উপাদান একত্রিত না হলে জুলাই সনদও হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণের ইতিহাসে আরেকটি সুন্দর কিন্তু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি।
এখন দায়িত্ব সরকারের—এই সনদকে কি তারা একটি কর্মতৎপর বাস্তবতায় রূপ দেবে, নাকি এটি থেকে যাবে রাজনৈতিক ইতিহাসের আরেকটি সাজানো ভাষণ হিসেবে। ভবিষ্যৎ উত্তর দেবে, জুলাই সনদ সত্যিই রূপান্তরের সূচনা করলো, নাকি প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি মাত্র।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
