জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ও ৯ মাসের সাংবিধানিক কার্যপরিকল্পনা
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮:৪২, ২৮ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০৯:৩৫, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নের পথে সরকার এখন আরেক ধাপ এগোচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ সুপারিশ অনুযায়ী, পুরো প্রক্রিয়া শুরু হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ নামে একটি বিশেষ আদেশ জারির মধ্য দিয়ে। এই আদেশ কার্যকর হওয়ার পরই শুরু হবে জনগণের সম্মতি যাচাইয়ের প্রস্তুতি, যার মূল ধাপ হলো একটি গণভোট।
কমিশন সূত্র জানায়, জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এই রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। গণভোটে নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে, জুলাই সনদে সংবিধান সংশোধনের যেসব প্রস্তাব আছে, সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কি না। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার চায়, বড় ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তন যেন রাজনৈতিক বিতর্ক নয়, বরং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হয়।
সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে সংসদ
ঐকমত্য কমিশনের খসড়া অনুযায়ী, আগামী জাতীয় সংসদ নিয়মিত আইনসভা হিসেবে কাজের পাশাপাশি প্রথম নয় মাস—অর্থাৎ ২৭০ দিন—সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবে। এই সময়ের মধ্যে সংসদ সদস্যরা প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা, পর্যালোচনা ও অনুমোদনের কাজ সম্পন্ন করবেন।
গণভোটে অনুমোদিত বিষয়গুলোই সংসদীয় আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং সেই অনুযায়ী সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে। কমিশন মনে করছে, এই পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা বাড়বে এবং ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন নিয়ে কোনো অস্থিরতা তৈরি হবে না।
জনগণের সম্মতি—মূল ভিত্তি
ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য জানান, গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে জনগণের সার্বভৌম মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক—এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণভোটকে পুরো প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'এই গণভোট শুধু সাংবিধানিক পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নতুন এক অধ্যায়। এতে মানুষ সরাসরি সিদ্ধান্ত নেবে তাদের রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে।'
প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে—সংবিধানের ভারসাম্য রক্ষায় সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার কাঠামো পুনর্বিন্যাস; নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; এবং মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রগুলোতে আধুনিক মানদণ্ডের সংযোজন।
সুপারিশ জমা দেবে ঐকমত্য কমিশন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আজ মঙ্গলবার দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাস্তবায়ন প্রস্তাব জমা দেবে। কমিশনের একাধিক সদস্যের মতে, এটি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি।
কমিশনের চেয়ারপারসন জানিয়েছেন, 'আমরা চাই, জুলাই সনদ শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হয়ে না থেকে বাস্তবায়নের এক রূপরেখা হিসেবে কার্যকর হোক। এই সুপারিশে আমরা বাস্তবতা, প্রশাসনিক সক্ষমতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ—সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় আনার চেষ্টা করেছি।'
কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে, জুলাই সনদের মূল উদ্দেশ্য হলো দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোকে টেকসই ও জবাবদিহিমূলক করা। এজন্যই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে পরিবর্তনগুলো হঠাৎ নয়, বরং প্রস্তুতি ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে কার্যকর হয়।
আইনগত ও প্রশাসনিক ধাপ
ঐকমত্য কমিশন বলছে, প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর প্রশাসনিক প্রস্তুতি শুরু হবে। এতে গণভোট আয়োজনের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে, যারা সময়সূচি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং ভোট প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিগত দিকগুলো তদারক করবে।
এরপর সংসদকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। সংসদীয় আলোচনায় অংশ নিতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি আমন্ত্রণ জানানো হবে। কমিশন মনে করছে, এতে সংস্কার প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এ প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ইতিমধ্যে আগ্রহ ও আলোচনার জন্ম নিয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক দল জানিয়েছে, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সাংবিধানিক সংস্কার হলে সেটি দেশের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।
তবে কিছু দল মনে করছে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেন কেবল সরকারি নিয়ন্ত্রণে না থাকে; বরং এতে বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। একটি বড় দলীয় নেতা বলেন, 'সংবিধান পরিবর্তন মানে জাতির ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন। তাই এটি কোনো এক পক্ষের একক সিদ্ধান্তে করা উচিত নয়।'
গণভোটের সময়সীমা ও তদারকি
প্রস্তাব অনুযায়ী, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের তিন মাসের মধ্যে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এই ভোট তদারকির দায়িত্বে থাকবে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক কমিটি, যার মধ্যে থাকবে নির্বাচন কমিশন, আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ।
গণভোটের ফলাফল প্রকাশের পর সংসদ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত প্রস্তাবগুলো অনুমোদন দেবে এবং তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় ধরা হয়েছে ২৭০ দিন।
ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যদি এই রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কারের ইতিহাসে এটি হবে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের পর প্রথমবারের মতো জনগণের সরাসরি ভোটে সাংবিধানিক সংশোধন কার্যকর হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
তাঁদের মতে, এই উদ্যোগ সফল হলে রাজনৈতিক আস্থার সঙ্কট কমবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা আরও গভীর হবে।
একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেন, 'জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এই প্রক্রিয়া যদি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, তবে তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থিতিশীল করে তুলবে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণই এবার হবে প্রকৃত নীতিনির্ধারক।'
এইভাবে জুলাই সনদ আর কেবল রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র নয়, বরং বাস্তবায়নের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছুঁয়ে যাচ্ছে দেশ।
