এক মহীয়সী নারী: প্রফেসর মাহফুজা খানম
রুনু আলী
প্রকাশ: ২০:৪৪, ৩১ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ২০:৫২, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
 
						
									একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষানুরাগী দীর্ঘ সময় ধরে যিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তিনি আমাদের প্রিয় মাহফুজা আপা, ছিলেন খেলাঘরের চেয়ারপারসন। যিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র শিক্ষার আলো ছড়িয়েই সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করা সম্ভব। সম্ভব অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিকবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা। সে প্রত্যয়ে তিনি শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নতুন প্রজন্মের কাছে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পান রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০১২’। এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। খেলাঘরের ইতিহাসে প্রফেসর মাহফুজা খানম-ই প্রথম যিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একটি রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন। এটি খেলাঘরের লাখো কর্মী, সংগঠকদের এক গর্বের অহংকার।
একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তার সাহসী অবদান ছিল। তাদের বাসায় মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিতেন। তিনি নিজে যুদ্ধকালীন সময়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ও খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিতেন। একমাত্র দেশাত্ববোধই তাকে এ কাজে সাহস জুগিয়েছিল। এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেকোন সময় হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল। কিন্তু কোন মৃত্যুভয় তার কাজের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অদম্য সাহসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি সংবাদ আদান-প্রদানের কাজও করেছেন।
তিনি এমন একটি পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন, যেখানে ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা চলত। তার পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকাস্থ স্বামীমাগে। এ বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর ’৫০-এর দশকের অনেক আন্দোলনের পরিকল্পনার সাক্ষী তাদের স্বামীবাগের ঐ বাড়িটি। আপার কাছ থেকে জেনেছি তাদের স্বামীবাগের বাড়িতে আসতেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, অজিত গুহ, আবদুলাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই, কবি সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ, কবি আহসান হাবীব প্রমুখ। তাদের বাড়িতে গানের আসর বসত, মঞ্চস্থ হতো নাটক। তিনি সেই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতেন। তিনি যে ভালো গান করতেন তার প্রমাণ আমরাও বারবার পেয়েছি।
 তাদের পরিবারকে বলা হতো সাত প্রজন্মের শিক্ষিত পরিবার। পারিবারিক পরিবেশটাও ছিল প্রগতিশীল। আপাসহ তার অন্যান্য ভাই-বোন আজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে তার মায়ের অবদান ছিল অনেকখানি। মা সালেহা খানম নারী শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু তিনি (সালেহা খানম) অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে রাজি হননি। তিনি বলতেন, আমার মেয়েরা আগে লেখাপড়া শেষ করবে, তারপর বিয়ে। আমার সাথে আলাপচারিতায় আপা একদিন বলছিলেন—
তাদের পরিবারকে বলা হতো সাত প্রজন্মের শিক্ষিত পরিবার। পারিবারিক পরিবেশটাও ছিল প্রগতিশীল। আপাসহ তার অন্যান্য ভাই-বোন আজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে তার মায়ের অবদান ছিল অনেকখানি। মা সালেহা খানম নারী শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু তিনি (সালেহা খানম) অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে রাজি হননি। তিনি বলতেন, আমার মেয়েরা আগে লেখাপড়া শেষ করবে, তারপর বিয়ে। আমার সাথে আলাপচারিতায় আপা একদিন বলছিলেন—
আমি তখন খুব ছোট, আমার বাবা ছিলেন স্বামীবাগের ক্রিসেন্ট ক্লাবের সভাপতি। আর চাচা আজিজুল হক ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। সন্ধ্যার পর উনাদের ভয়ে আমরা পড়তে বসতাম। কারণ ওই সময়টাতে তারা দুজন পুরো মহল্লায় ঘুরতেন আর কান পেতে শুনতেন কোন বাসায় ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে না। যে বাসায় পড়ার আওয়াজ পাওয়া যেত না, সেই বাসায় ঢুকে খবর নিতেন কেন বাচ্চারা পড়ছে না। আসলে সে সময়ে পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম।
এ রকম একটা পারিবারিক পরিবেশই তার মানস গঠনে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ইডেন কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন ১৯৬৩ সালে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি ও এমএসসি করেন। তিনি ছিলেন ‘ছাত্র ইউনিয়নের’ একজন বলিষ্ঠ নেত্রী। ডাকসু’র ইতিহাসে তিনিই একমাত্রা নারী ভিপি ছিলেন। ১৯৬৬-৬৮ সালে তিনি ডাকসুর ভিপি পদে নির্বাচিত হন। দোর্দণ্ড প্রতাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন ছাত্র ও গণআন্দোলনে। ৬ দফা আন্দোলন জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছেন। যেহেতু তিনি সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সে কারণে তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা ছিল। তিনি এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডনের সাকসেস ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পান। তার নামে মামলা থাকায় লন্ডন দূতাবাস থেকে তাকে ভিসা দেয়নি। ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করার পরও তাকে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। ফলে ১৯৬৯ সালে পুরানা পল্টন গার্লস কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর ইডেন কলেজ, কুমিলা উইমেন্স কলেজ, লেদার টেকনোলজি কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। চাকরি জীবনের শেষ দিকে মাহফুজা খানমকে সরকারি সঙ্গীত কলেজে অধ্যক্ষ করে পাঠানো হয়। ২০০৩ সালে মানিকগঞ্জের সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদে থাকা অবস্থায় তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।
তার স্বামী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছ থেকে তিনি এতটাই স্বাধীনতা পেয়েছেন যে, তার সারা জীবনের উপার্জনের টাকা তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করেছেন। এখনও অনেক গরিব ছাত্র-ছাত্রীর লেখাপড়ার খরচ তার অর্থে চলছে। তার উপার্জিত অর্থ কখনো তার পরিবারে ব্যয় করতে হয়নি। বর্তমানে তার অর্থে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ১৭টি ট্রাস্ট পরিচালিত হচ্ছে। তার বাড়িতে যারা কাজ করে তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও সব সময় তিনিই বহন করতেন। তার অগণিত ছাত্র-ছাত্রী তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় তার সামনে মাথা নিচু করে থাকত। 
শিক্ষা যে একটি পরিবারকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা আপার কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়। একদিন সন্ধায় তার বাসায় গিয়েছি। আন্তরিক পরিবেশে তার সাথে বসে চা খাচ্ছি। নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। এর মাঝে তিনি একটি ঘটনার কথা বললেন—
আমার বাড়ির গৃহপরিচারকের মেয়ে লেখাপড়া করত। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর লেখাপড়ার খরচের দায়িত্বটা আমিই নিই। 'ল' পাস করে সে এখন আইন ব্যবসা করছে। একদিন হঠাৎ মেয়েটি ওর বাবার সঙ্গে আমাদের বাসায় এসে বিয়ের দাওয়াত দেয়। তার হবু স্বামী ও শ্বশুর দুজনই আইনজীবী। মেয়েটির বাবা তখনও আমাদের বাসায় কাজ করতেন। আমরা প্রত্যেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী একেকটি ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিই। এতে তাদের পারিবারিক মর্যাদাও বেড়ে যায়।
প্রফেসর মাহফুজা খানম World Federation of Teachers' Unions (FISE)-এর চেয়ারপারসন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটির দুবারের সফল জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন, সবশেষ ছিলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। এছাড়াও তিনি ছিলেন পেশাজীবী নারী সমাজ, শিশু বিকাশ ছায়া এবং খেলাঘরের চেয়ারপারসন। প্রফেসর মাহফুজা খানম বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। এর মধ্যে দুই খণ্ডে ‘গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন’ ও ‘মধুদা’ উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার উন্নয়নে তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন।
সব পরিচয়ের মাঝে তার যে পরিচয়টি এখন সবার আগে তা হচ্ছে, তিনি খেলাঘরের চেয়ারপারসন ছিলেন। সেই ৮০-র দশক থেকে তিনি সরাসরি খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটি তথা খেলাঘর আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। খেলাঘরের চরম দুঃসময়ে তিনি সম্মুখ কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিকবোধ সম্পন্ন অগ্রসর চিন্তার প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। খেলাঘর সংগঠকদের তিনি মাতৃস্নেহে বুকে আগলে রাখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন খেলাঘর আন্দোলন আরও এগিয়ে যাবে, গড়ে উঠবে শিশুর হাসিতে উজ্জ্বল একটি বাংলাদেশ।
খেলাঘরের কোনও নিজস্ব অফিস ছিল না। মাহফুজা আপা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একটি সরকারি বাড়ির ব্যবস্থা করেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় অফিসটিও আপার চেষ্টাতেই পাওয়া। খেলাঘরের নিজস্ব ফান্ড ছিল না, বর্তমানে খেলাঘর ফান্ডের সিংহভাগ আপার মাধ্যমেই সংগৃহীত হয়েছে। সংগঠনের নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ, যিনি চেয়ারপারসন হয়েও আমাদের সাথ একজন কর্মীর মতো মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাকে আমরা চরম অপমান করে বিদায় দিয়েছি। ২০২৪-এর ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই তাকে অপমানিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেককেই দেখেছি বিভিন্ন কর্মসূচিতে চেয়ারপারসনকে পাশ কাটিয়ে চলতে। অবশেষে খেলাঘর কেন্দ্রীয় দপ্তরে মব সৃষ্টি করে মাহফুজা খানমকে চেয়ারপারসন পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং সংগঠনের গায়ে কালিমা লেপন করা হয়; যা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
মাফফুজা আপা সম্পর্কে এত স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। তার সাথে আমার সাংগঠনিক সম্পর্কের বাইরেও নিবিড় পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আমি তাকে আপা ডাকলেও তিন প্রায়শই বাবা সম্বোধন করতেন। জীবনে একটা দুঃখ থেকে যাবে তা হচ্ছে, যেদিন তার মৃত্যু সংবাদ শুনলাম সেদিন আমি দেশের বাড়িতে এবং অসুস্থ। প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত। সতীর্থদের সাথে এমনকি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলে এই শরীরে ৬/৭ ঘণ্টা জার্নি করা ঠিক হবে না বলে জানান। আর কোনদিন শুনতে পাব না—কিরে বাবা তোর কি খবর?
লেখক: শিশু সংগঠক

 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													 
													