আরপিও পরিবর্তন
আদালত ঘোষিত ফেরারি আসামি প্রার্থী হতে পারবে না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫:৫৫, ৪ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৫:৫৯, ৪ নভেম্বর ২০২৫
						গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। গ্রাফিক্স : সমাজকাল
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অধ্যাদেশ জারি করেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। সোমবার (৩ নভেম্বর) সংশোধিত আরপিও অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এর আগে ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।
এতে একগুচ্ছ পরিবর্তনের পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন কিছু বিধান। এই সংশোধিত আরপিও দিয়েই সব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন।
নতুন আরপিও অধ্যাদেশে এবার সংযোজন করা হয়েছে, আদালত ঘোষিত ফেরারি আসামি ভোট করতে পারবেন না। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী ফিরেছে। এছাড়া একক প্রার্থীর আসনে ‘না’ ভোট ব্যবস্থা এসেছে।
আরপিওতে বলা হয়েছে, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি চালু করা, এআইয়ের অপব্যবহারকে নির্বাচনি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, জোটে করলেও ভোট করতে হবে নিজ দলের মার্কায়, সমভোট পেলে হবে পুনভোট, জামানতের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ, দল আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা, অনিয়মের কারণে পুরো আসনের ভোট বাতিলের বিধান এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য (ভোটে অযোগ্য এমন) দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও ব্যবস্থা নিতে পারবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন।
২ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর নাম। এবার সংশোধিত আরপিওয়ের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও দৃশ্যমান হবে।
৮ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, পরিমার্জন করে ভোটকেন্দ্র (পোলিং স্টেশন) প্রস্তুতের ক্ষমতা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার হাতে থাকবে। তারা তালিকা করে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন নেবেন।
৯ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করা হয়েছে; রিটার্নিং অফিসার কোনো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করলে তা ইসিকে অবহিত করতে হবে।
১২ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, আদালত কাউকে ফেরারি বা পলাতক আসামি ঘোষণা করলে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন। এতে পলাতক আসামি এবার প্রার্থী হতে পারবেন না। এছাড়া কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা অন্য কোনো পদে থাকলেও সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার প্রার্থী হতে অযোগ্য হবেন।
এদিকে সংশোধিত আরপিওতে কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদকে ‘লাভজনক’ পদ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদে থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আর থাকলো না।
এবার হলফনামায় দেশে এবং বিদেশে আয়ের উৎস থাকলে তা অবশ্যই জানাতে হবে। আর দাখিল করতে হবে সবশেষ বছরের রিটার্ন। এছাড়া যুক্ত করা হয়েছে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য সংক্রান্ত হলনামায় অসত্য তথ্যের প্রমাণ পেলে ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা থাকছে নির্বাচন কমিশনের।
১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া জামানতের পরিমাণ হবে ৫০ হাজার টাকা। আর রিটার্নিং কর্মকর্তার আদেশে ক্ষুব্ধ হলে প্রার্থী বা ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কোনো সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানও আপিল করার সুযোগ পাবে বলে ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে।
১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, ‘না’ ভোটের বিধান। কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যদি একজন থাকে, তাহলে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের বিধান থাকবে। আর দ্বিতীয়বার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত একক প্রার্থী থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে বলে সংশোধিত আরপিওতে বলা হয়েছে।
এদিকে নিবন্ধিত একাধিক রাজনৈতিক দল জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীক বা মার্কায় ভোট করতে হবে বলে ২০ নম্বর সংশোধিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। আর নির্বাচনি এজেন্টকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার ভোটার হতে হবে বলে ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করে বলা হয়েছে।
২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বাড়ানো হয়েছে প্রিজাইডিং অফিসারের ক্ষমতা। ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত বা বিঘ্নিত হওয়ার ক্ষেত্রে ভোট স্থগিতের পর তা নির্ধারিত সময়ে শুরু না করা গেলে বা ব্যালট বাক্স খোয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রিজাইডিং অফিসার তা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ভোটের নতুন দিন ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।
২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের ‘ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিধান’ বিলুপ্ত করা হয়েছে।
২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং। এতে প্রবাসী, নির্বাচনি এলাকার বাইরে কর্মরত সরকারি চাকরিজীবী এবং কারাগারে বা হেফাজতে থাকা ব্যক্তি পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন।
২৯ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করে ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ভোট গণনার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিত থাকার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণনার ফল যোগ করার আগে রিটার্নিং কর্মকর্তা ‘প্রয়োজন মনে করলে’ প্রিজাইডিং অফিসারের হাতে বাতিল হওয়া ভোট পরীক্ষা করতে পারবেন। তিনি যদি এমন ব্যালট পান—যা বাদ দেওয়া ঠিক হয়নি, সেটি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ভোট হিসাবে গণ্য হবে।
৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সমভোট পেলে লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট করা যাবে। আগে সমভোট প্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে লটারি করে একজনকে নির্বাচিত করার বিধান ছিল।
এছাড়া নির্বাচনি ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করে ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করা হয়েছে। ভোটার প্রতি ব্যয় সর্বোচ্চ ১০ টাকা ঠিক করা হয়েছে। তবে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার বেশি হওয়া যাবে না। আর যুক্ত করা হয়েছে, অনুদান হিসেবে পাওয়া অর্থের তালিকা বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট করে ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান ।
৭৩ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, মিথ্যা তথ্য, অপতথ্য, গুজব এবং এআইয়ের অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও দলের বিষয়ে অপরাধের বিধান। 
এছাড়া ৭৪, ৮১, ৮৭ ও ৮৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ছোটখাট পরিমার্জন আনা হয়েছে। আর উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক বা ডিআইজি পদমর্যাদা পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলির তথ্য নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। 
৯০ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, দল নিবন্ধন ও আর্থিক অনুদানের বিষয় এবং নিবন্ধন স্থগিত হলে প্রতীক স্থগিতের বিষয়।
৯১ নম্বর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে অনিয়মের জন্য কেন্দ্রের ভোট বাতিলের পাশাপাশি প্রয়োজনে পুরো নির্বাচনি এলাকার ফল বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। আরও যুক্ত করা হয়েছে, আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দণ্ডের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান আর দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান।
এদিকে বিধান রাখা হয়েছে, আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও ব্যবস্থার। এ অনুচ্ছেদে হলফনামায় অসত্য তথ্যে যাচাই ও ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।
উল্লেখ্য, আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ জারির মধ্যে শেষ হল নির্বাচনি আইনের সব ধরনের সংস্কার কাজ। ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা আইন সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান আইন সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন, ভোটকেন্দ্র নীতিমালা, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালা, সাংবাদিক নীতিমালাসহ সব ধরনের আইন-বিধি সংস্কার করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন।
