কিশোরীর রংতুলির আঁচড়ে গাজার করুণ চিত্র
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮:২৬, ৬ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২৩:৫৩, ৬ নভেম্বর ২০২৫
ইয়ারা ইউসুফ আবু কুয়াইকের আঁকা চিত্র। ছবি: আল-জাজিরা
যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। গাজার শিশুদেরও করুণ অবস্থা। যখন গাজার আকাশ থেকে প্রতিদিন বোমা ঝরেছে, তখনও কিছু শিশু-কিশোর রংতুলি আঁকড়ে বেঁচে ছিল। ১৬ বছরের ইয়ারা ইউসুফ আবু কুয়াইক তেমনই একজন।

ইয়ারা ইউসুফ আবু কুয়াইক। ছবি: আল-জাজিরা
ইসরায়েলের অব্যাহত যুদ্ধের বিভীষিকায় চারপাশ যখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তখন নিজের বেদনা, ভয় ও ক্ষোভকে ক্যানভাসে ছড়িয়ে দেন এই কিশোরী শিল্পী। তার ছবিতে ফুটে ওঠে গাজার শিশুদের না বলা গল্প, প্রতিদিনের অনাহার, তৃষ্ণার কষ্ট এবং অনিশ্চয়তায় ভরা শৈশব।
ইয়ারা জানান, একসময় সে আঁকত রঙিন ফুল, প্রজাপতি, খেলার দৃশ্য। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার চিত্রে নেমে আসে ছাইরঙা বাস্তবতা। সে দেখতে পায় ক্ষুধায় ক্লান্ত শিশুদের পানির জন্য হাহাকার, ছিন্নভিন্ন তাঁবু, রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া পরিবার। নিজের চোখে দেখা এসব যন্ত্রণা থেকেই জন্ম নেয় তার নতুন আঁকার বিষয়।
ইয়ারা ইউসুফ আবু কুয়াইকের আঁকা চিত্র। ছবি: আল-জাজিরা
ইয়ারা বলেন, ‘আমি এমন শিশুদের এঁকেছি, যারা মাটিতে ঘুমাচ্ছে, চারপাশে আগুন আর গোলার শব্দ। তারা কোথাও নিরাপদ নয়, এমনকি তাঁবুতেও না।’
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক অভিযানে এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৬৯ হাজার মানুষ নিহত এবং এক লাখ সত্তর হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। নিহতদের বড় অংশই শিশু। শুধু শারীরিক ক্ষত নয়, মনোজগতে যে আঘাত তারা বহন করছে, তা আরোগ্যহীন।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, গাজার ৮০ শতাংশ শিশুই এখন তীব্র ট্রমায় ভুগছে। কারও মাথাব্যথা, কারও হাড়ের ব্যথা, কারও আবার চুল পড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তায় দুর্বল হয়ে পড়ছে শরীর ও মন দুটোই।
সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, যুদ্ধ শুরুর আগেই গাজার চারজনের মধ্যে তিনজন শিশু হতাশা, ভয় ও দুঃখে ডুবে ছিল। অর্ধেকেরও বেশি শিশুর মনে এসেছিল আত্মহত্যার চিন্তা। যুদ্ধের এই দীর্ঘ দুই বছর তাদের সেই মানসিক ক্ষতকে আরও গভীর করেছে। বহু শিশু একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, হারিয়েছে পিতামাতা, বন্ধুবান্ধব ও ঘরবাড়ি।
ইয়ারা ইউসুফ আবু কুয়াইকের আঁকা চিত্র। ছবি: আল-জাজিরা
তবু ইয়ারা হাল ছাড়েনি। তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার ছবি দেখে বিশ্ব জানুক, আমরা কেমন আছি। আমি গাজার সব শিশুর পক্ষে বলতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই।’
গাজার শিশুদের জন্য এখন খেলাধুলার মাঠ নেই, নেই নির্ভরতার ছায়া। তবু তারা আঁকে, গান গায়, মাটিতে আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করে। ইয়ারার ছবিগুলো যেন তাদের আত্মার আর্তনাদ। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রঙ সাক্ষ্য দেয় এক প্রজন্মের নীরব প্রতিবাদের। যুদ্ধ তাদের হাসি কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু থামাতে পারেনি কণ্ঠ, রংতুলির আচড়।
ইয়ারা কুয়াইকের মতো এই কিশোরী শিল্পীরা আমাদের শেখায়, ধ্বংসের মাঝেও সৃষ্টিশীলতা টিকে থাকতে পারে। কারণ, যন্ত্রণার রং কখনো কখনো হয়ে ওঠে মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিবাদ।
সূত্র: আল-জাজিরা
