প্রশান্তিময় জীবনের খোঁজে মার্কাসের ৪ শিক্ষা
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২১:২৯, ৪ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২১:৫৭, ৪ নভেম্বর ২০২৫
পৃথিবী যত জটিল হচ্ছে, জীবনের সহজ সূত্র খোঁজে পাওয়া তত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অথচ রোমের সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস প্রায় দুই হাজার বছর আগে যে চিন্তাধারা রেখে গেছেন, তা আজও মানুষকে শান্ত ও অর্থবহ জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মেডিটেশন’ প্রকাশযোগ্য কোনো পাণ্ডুলিপি ছিল না, বরং এটি নিজেকে সংশোধন ও জীবনের ভারসাম্য রক্ষার ব্যক্তিগত ডায়েরি ছিল। সেই আত্মসলোচনায় উঠে এসেছে চারটি নিয়ম, যা অনুসরণ করলে প্রশান্তিময় জীবন লাভ করা যায়।
এক. মূল বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া
মার্কাস অরেলিয়াস বলেছেন, ‘যদি প্রশান্তি চান, কাজ কম করুন।’ কাজ কম করার অর্থ অকর্মণ্যতা নয়, বরং অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হওয়া। জীবনে যা সত্যিই জরুরি, তা বেছে নেওয়া এবং বাকিগুলো ছেঁটে ফেলা। প্রতিদিনের জীবনে আমরা কত ছোট ছোট বিষয়ে সময় নষ্ট করি, কত অপ্রয়োজনীয় দায়িত্ব নিই শুধুমাত্র সমাজের চোখে ভালো দেখাতে। অথচ এতে প্রশান্তি আসে না, আসে ক্লান্তি। অরেলিয়াস শেখান, জীবনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য চাই প্রচণ্ড মনোযোগ। যখন অল্প কিছু কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া হয়, তখন কাজের মান বাড়ে, মনের অস্থিরতা কমে।
দুই. ভবিষ্যৎ বা অতীত নিয়ে দুঃখিত না হওয়া
মার্কাস অরেলিয়াস বলেছেন, ‘সমগ্র জীবনের চিন্তায় আপনার কল্পনাকে ভেঙে ফেলবেন না, বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গেই থাকুন।’ অরেলিয়াসের এই উপদেশ মানব মনের এক গভীর সত্যকে স্পর্শ করে। আমরা এমন সব আশঙ্কা করি, যা কখনোই ঘটবে না। ভবিষ্যতের বিপদের আশঙ্কায় বর্তমানে অস্থির হয়ে যাই। অথচ বাস্তব সমস্যা খুব কমই আমাদের এমনভাবে ক্ষতি করে, যেমনভাবে কল্পিত সমস্যা করে। স্টোইক দার্শনিকদের মতে, মানুষের শক্তি বর্তমানেই। ভবিষ্যৎ ভয় বা অতীত অনুশোচনায় মন হারালে, সেই শক্তি নষ্ট হয়। বর্তমান মুহূর্তে কী করা যায়, এই বোধই মানুষকে দৃঢ় করে তোলে। যে নিজের চিন্তাকে বর্তমানের মধ্যে রাখে, সে ভয় পায় না, সে পথ হারায় না।
তিন. অভিযোগ না করা
মার্কাস অরেলিয়াস বলেছেন, ‘বাইরে নয়, নিজের ভেতর তাকান।’ এই বাক্যটি শুধু আত্মশুদ্ধির আহ্বান নয়, জীবনের এক অনবদ্য মন্ত্র। মানুষ যখন অভিযোগ করে, তখন সে নিয়ন্ত্রণ হারায়। অভিযোগ সমস্যা সমাধান করে না, বরং মনকে তিক্ত করে। মার্কাস অরেলিয়াসের ভাষ্য হলো, যে অন্যের আচরণে বিরক্ত হয়, সে যেন আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে যে, আমিও কি এমনটা কখনো করিনি? এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে বিনয়ী করে, সহানুভূতিশীল করে। জীবনের অনেক কষ্টই আসে এমন বিষয় থেকে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। অন্যের আচরণ, সময়ের রূপরেখা, ভাগ্যের পরিণতি, এসব নিয়ে অভিযোগ করলে কিছুই বদলায় না। বরং নিজের মনোভাব বদলালে জীবন বদলায়।
চার. অন্যের মতামত নিয়ে না ভাবা
মার্কাস অরেলিয়াস বলেছেন, ‘আমরা নিজেদের ভালোবাসি, অথচ অন্যের মতামত নিয়েই বেশি ভাবি।’ মানুষ নিজেকে ভালোবাসে বলেই সুখ চায়, কিন্তু সে সুখের চাবিকাঠি অন্যের হাতে তুলে দেয়। কে কী ভাববে, কে সমালোচনা করবে, এই ভাবনায় আমরা নিজেদের প্রকৃত সত্তাকে হারিয়ে ফেলি। অরেলিয়াস শেখান, মানুষের আত্মমর্যাদা নিজের বিবেকের হাতে থাকা উচিত, অন্যের মন্তব্যে নয়। মানুষের মতামত তার মানসিক অবস্থা, অভিজ্ঞতা ও পক্ষপাত দ্বারা নির্ধারিত, যা আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই সেটির ওজন নিজের জীবনে টেনে আনা অনুচিত। সমালোচনা শুনুন, কিন্তু মূল্যায়ন করুন কেবল তখনই, যখন তা আপনার উন্নতিতে সহায় হয়। অন্যথায়, নীরবে নিজের পথে চলুন।
মার্কাস অরেলিয়াসের এই চারটি সূত্র একসঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের মানচিত্র। মূল বিষয়ের প্রতি মনোযোগ, বর্তমানের প্রতি সচেতনতা, অভিযোগহীন মন এবং আত্মবিশ্বাস তথা অন্যের কথা কানে না নেওয়া, এই চার গুণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে প্রশান্ত ও অর্থবহ জীবন। এগুলো সহজ নয়, তাই প্রতিদিনের চর্চা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ চাই। কিন্তু যখন কেউ এই নীতিগুলো আয়ত্ত করতে পারে, তখন তার জীবনে বাহ্যিক বিশৃঙ্খলার মাঝেও থাকে গভীর প্রশান্তি।
