যুদ্ধবিরতির এক মাস পরও গাজায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত, নিহত ছাড়াল ৬
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১১:০৭, ৯ নভেম্বর ২০২৫
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও ফিলিস্তিনের গাজায় থামছে না ইসরায়েলি হামলা ও সহিংসতা। গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার হচ্ছে নতুন নতুন মৃতদেহ। ফলে বেড়েই চলেছে নিহতের সংখ্যা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ১৬৯ জনে।
গত মাসে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পরও নতুন করে অন্তত ২৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে এখনো উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে মরদেহ খুঁজে পাচ্ছেন।
শনিবার উত্তর গাজায় ‘ইয়েলো লাইন’ নামে পরিচিত সীমারেখা অতিক্রমের অভিযোগে ইসরায়েলি বাহিনী এক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করেছে। এই ‘ইয়েলো লাইন’ আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গঠিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর পিছু হটার কথা ছিল।
একইদিন দক্ষিণ গাজাতেও আরেক ফিলিস্তিনি নিহত হন। ইসরায়েল দাবি করেছে, ওই ব্যক্তি সেনাদের জন্য “তাৎক্ষণিক হুমকি” তৈরি করেছিলেন।
সীমারেখার কাছে যাওয়া অসহায় পরিবারগুলোকেও লক্ষ্য করে গুলি চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। খান ইউনিস এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিস্ফোরকের আঘাতে এক ফিলিস্তিনি শিশুর মৃত্যুর খবরও নিশ্চিত করেছে নাসের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
গাজায় চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন এমন রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং পুনরায় খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ডব্লিউএইচও’র তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ফিলিস্তিনি রোগী মিসর ও অন্য দেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পেরেছেন। কিন্তু এখনও ১৬ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
সংস্থাটি জানিয়েছে, ওষুধ, খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ এখনো যুদ্ধবিরতির আগের তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পর্যায়ে রয়েছে।
গাজার পাশাপাশি পশ্চিম তীরজুড়েও সহিংসতা বেড়েছে। দক্ষিণ নাবলুসের বেইতা শহরে জলপাই সংগ্রহে ব্যস্ত কৃষক, সাংবাদিক ও কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা।
মানবাধিকারকর্মী জোনাথন পোলাক জানান, মুখোশধারী ডজনখানেক বসতি স্থাপনকারী লাঠি ও বড় পাথর নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় অন্তত ডজনখানেক মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একাধিক সাংবাদিক ও এক বৃদ্ধ কর্মী রয়েছেন।
প্যালেস্টাইন জার্নালিস্টস সিন্ডিকেট জানিয়েছে, আহতদের মধ্যে রয়েছেন রানিন সাওয়াফতে, মোহাম্মদ আল-আত্রাশ, লুয়াই সাঈদ, নাসের ইশতাইয়েহ ও নাঈল বুয়াইতেল। তারা এ ঘটনাকে “সাংবাদিক হত্যার উদ্দেশ্যে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে অভিহিত করেছে।
রয়টার্সও নিশ্চিত করেছে, তাদের দুই কর্মী—এক সাংবাদিক ও নিরাপত্তা পরামর্শক—হামলায় আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে পশ্চিম তীরে অন্তত ৭০টি শহর ও গ্রামে ১২৬টি হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে ৪ হাজারেরও বেশি জলপাইগাছ ধ্বংস করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজা ও পশ্চিম তীরের চলমান সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং বিভিন্ন মানবিক সংস্থা যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ইসরায়েলকে কঠোরভাবে চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও গাজার পরিস্থিতি “মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে”। সাহায্য পৌঁছানোর পথ এখনো বন্ধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, আর অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতির পরও এই নতুন পর্যায়ের হামলা ও সহিংসতা প্রশ্ন তুলছে—এই যুদ্ধ আসলে কখন শেষ হবে? যখন ৬৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে গেছে, লক্ষাধিক মানুষ আহত বা গৃহহীন, তখন নতুন করে সহিংসতা শুধু গাজা নয়, গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকেই হুমকির মুখে ফেলছে।
