নবায়নযোগ্য জ্বালানির ঐতিহাসিক জয়
নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন ও ভারত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬:১২, ৭ অক্টোবর ২০২৫

বিশ্বের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটেছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কয়লাকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎসে পরিণত হয়েছে—এমন তথ্য দিয়েছে বৈশ্বিক জ্বালানি গবেষণা সংস্থা এমবার ।
বিশ্বজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে, তবে সৌর ও বায়ুশক্তির প্রবৃদ্ধি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, অতিরিক্ত বিদ্যুতের পুরো চাহিদা এ দুই উৎসই মেটাতে সক্ষম হয়। বরং কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহার সামান্য কমেছে বলেও সংস্থাটি জানিয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশ এগিয়ে, উন্নত দেশ পিছিয়ে
এই অগ্রগতির নেতৃত্বে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো—বিশেষ করে চীন ও ভারত।
চীন একাই বিশ্বের মোট সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ সক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি যুক্ত করেছে, যা তাদের বিদ্যুৎ চাহিদা ছাড়িয়ে গেছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ২% কমিয়েছে।ভারতও নতুন সৌর ও বায়ু প্রকল্পের মাধ্যমে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রবৃদ্ধির চেয়ে দ্রুত, ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হয়েছে। ইউরোপে আবার দুর্বল বায়ু ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে কয়লা ও গ্যাসে নির্ভরতা বেড়েছে।
সৌরশক্তির বিস্ফোরণ
বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির এই উত্থানে সৌরশক্তিই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
এমবারের তথ্যে, ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ চাহিদার ৮৩% বৃদ্ধিই এসেছে সৌরশক্তি থেকে।
চমকপ্রদভাবে, এখন নিম্ন আয়ের দেশগুলোতেই সৌরবিদ্যুতের ৫৮% উৎপন্ন হয়—যা মূলত দাম কমে যাওয়ার ফল। ১৯৭৫ সাল থেকে সৌর প্যানেলের দাম কমেছে প্রায় ৯৯.৯%।
পাকিস্তান ২০২৪ সালে ১৭ গিগাওয়াট সৌর প্যানেল আমদানি করেছে—এক বছরে দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধি। আফ্রিকাও দ্রুত এগোচ্ছে; দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, জাম্বিয়া ও বতসোয়ানার মতো দেশগুলোতে সৌর বিদ্যুৎ সক্ষমতা বহুগুণে বেড়েছে।
নতুন চ্যালেঞ্জ: জলসম্পদ ও অবকাঠামো
তবে এই অগ্রগতি নতুন সমস্যাও তৈরি করছে। আফগানিস্তানে সৌরচালিত পানির পাম্প ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। গবেষক ড. ডেভিড ম্যান্সফিল্ডের নেতৃত্বে পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে কয়েকটি অঞ্চলে পানি সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এমবারের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মালগোরজাতা উইআত্রোস-মোটিকা একে বলেছেন, “এটি এক ‘গুরুত্বপূর্ণ মোড়’, যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখন বিদ্যুৎ চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে।”
বিশ্বের ‘সূর্য বেল্ট’ (এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা) ও ‘বায়ু বেল্ট’ (ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা) অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন। সূর্য বেল্টে সৌরবিদ্যুৎ ও ব্যাটারি সংরক্ষণ ব্যবস্থাই দ্রুত সমাধান দিচ্ছে; অন্যদিকে বায়ু বেল্টে উচ্চ সুদ ও শীতকালীন বায়ু-ঘাটতির কারণে ব্যয় বাড়ছে।
চীনের অপ্রতিরোধ্য নেতৃত্ব
নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পে চীনের প্রভাব এখন অনন্য উচ্চতায়।
২০২৫ সালের আগস্টে দেশটির ক্লিনটেক রপ্তানি রেকর্ড ২০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে—যার বড় অংশই ইলেকট্রিক যান (২৬% বৃদ্ধি) ও ব্যাটারি (২৩% বৃদ্ধি) বিক্রি থেকে এসেছে। এখন ব্যাটারি ও ইভি রপ্তানির সম্মিলিত মূল্য চীনের সৌর প্যানেল রপ্তানির দ্বিগুণ।
বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এটি এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা। নবায়নযোগ্য জ্বালানি শুধু পরিবেশ নয়, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিকেও পুনর্গঠন করছে।
যেসব দেশ দ্রুত অভিযোজন করতে পারবে—বিশেষত সৌর ও ব্যাটারি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করবে—তাদেরই আগামী দশকে জ্বালানি নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ থাকবে।
সূত্র : বিবিসি