নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলিম আনোয়ার সাদাত
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩:২৪, ১১ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০০:৩২, ১২ অক্টোবর ২০২৫

বিশ্ব রাজনীতিতে এক সময় সাহসিকতা, দূরদৃষ্টি ও শান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত।তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির আলো জ্বালাতে নিজের জীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলেন। ইতিহাস তাকে শুধু মিসরের নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের গর্ব হিসেবে স্মরণ করে। ১৯৭৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে তিনি হয়ে ওঠেন নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলিম নেতা।
আনোয়ার সাদাত জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর, মিসরের মিত আভ কুম গ্রামে। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ছোটবেলা থেকেই দৃঢ়সংকল্প ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। কায়রোর সামরিক একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি মিসরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। জীবনের প্রথম পর্যায়েই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বহুবার কারাবরণ করেন। স্বাধীনচেতা মনোভাব, দৃঢ় বিশ্বাস ও মিসরের স্বাধীনতার প্রতি তার আনুগত্য তাকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
১৯৫২ সালে গামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে যখন রাজা ফারুকের পতন ঘটে, তখন সাদাত ছিলেন সেই বিপ্লবের অন্যতম অংশীদার। পরবর্তী সময়ে নাসেরের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে তিনি রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুরুতে তাকে অনেকে অস্থায়ী নেতা ভেবেছিলেন, কিন্তু পরে প্রমাণ করে দেন, তিনি ছিলেন স্বাধীন সিদ্ধান্তের অধিকারী, দৃঢ়চেতা এক নেতা।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আনোয়ার সাদাত মিসরের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। সোভিয়েত প্রভাব থেকে দেশকে সরিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন। তবে তার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় হলো ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ ও পরে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। ১৯৭৩ সালে তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইয়োম কিপুর যুদ্ধ পরিচালনা করেন, যাতে আরব সেনারা প্রাথমিকভাবে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু এই যুদ্ধের পর তিনি বুঝতে পারেন, যুদ্ধ নয়, শান্তিই হতে পারে টেকসই সমাধানের পথ।
১৯৭৭ সালে তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নেন, যা গোটা বিশ্বের দৃষ্টি কাড়ে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো আরব নেতা হিসেবে তিনি ইসরায়েল সফর করেন এবং তাদের পার্লামেন্ট ‘নেসেট’-এ ভাষণ দেন। এই সাহসী পদক্ষেপেই মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনা হয়।
এরপর আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিনের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার উদ্যোগ নেন। এর ফলে ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস’ বা ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এই সমঝোতা দলিলের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা দুই দেশের দীর্ঘ দিনের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ প্রশস্ত করে।
এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৮ সালে আনোয়ার সাদাত ও মেনাখেম বেগিন যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্বের অনেকেই এই চুক্তিকে সাহস ও কূটনীতির এক অনন্য মাইলফলক হিসেবে দেখেন। তবে আরব বিশ্বের একটি বড় অংশ আনোয়ার সাদাতের এই পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচনা করে। এর ফলেই দেশে ও বিদেশে তিনি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর কায়রোয় এক সামরিক কুচকাওয়াজের সময় তাকে হত্যা করা হয়।