এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে কেন এত আলোচনা
মাইসারা জান্নাত
প্রকাশ: ১৩:১৪, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি: সংগৃহীত
আকাশের বুকে আতঙ্কের নাম মার্কিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অসামান্য ক্ষমতা রয়েছে এর। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি এটি। একে বলা হয় পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টিরোল বা বহুমুখী যুদ্ধবিমান, যা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা এবং মারণঘাতী আকাশযান হিসেবে বিবেচিত। লকহিড মার্টিনের তৈরি এই বিমানটি আকাশযুদ্ধে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
সম্প্রতি সৌদি আরেবর কাছে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান বিক্রির কথা জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এমন পরিকল্পনার সমালোচনা করছেন ইসরায়েলের সমর্থক গোষ্ঠিরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানান, তিনি সৌদির কাছে যে যুদ্ধবিমানগুলো বিক্রির পরিকল্পনা করছেন, সেগুলো ইসরায়েলের কাছে বিক্রি করা মডেলগুলোর মতো প্রায় একই রকম হবে। ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানকে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি জানি, তারা চাইবে আপনারা যেন অপেক্ষাকৃত কম সক্ষমতার বিমান পান। আমার মনে হয় না তাতে আপনারা খুব খুশি হবেন।’

ট্রাম্পের সঙ্গে বিন সালমান। ছবি: সংগৃহীত
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিন সালমানের এই প্রসঙ্গ গণমাধ্যমে আসার পর এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কি আছে এই যুদ্ধবিমানে? চলুন জেনে নিই।
এই যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান বিশেষত্ব হলো এর অত্যাধুনিক স্টেলথ বা অদৃশ্য থাকার প্রযুক্তি। শত্রুর অত্যন্ত শক্তিশালী রাডার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে এটি অনায়াসে প্রতিপক্ষের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে পারে। এর জ্যামিতিক গঠনশৈলী এবং গায়ে লাগানো বিশেষ আবরণের কারণে রাডার তরঙ্গ একে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। বিশাল আকৃতির এই যুদ্ধবিমানটি আকাশে ওড়ার সময় রাডারে ধরা পড়লে সেটিকে মনে হয় ছোট কোনো গলফ বল বা ক্ষুদ্র পাখির মতো। এই অদৃশ্য ক্ষমতার কারণে এটি প্রথমে শত্রুকে দেখতে পায় এবং নিজের অবস্থান গোপন রেখেই আক্রমণ চালাতে পারে।

এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি: সংগৃহীত
এফ-৩৫ এর আরেকটি যুগান্তকারী দিক হলো এর সেন্সর ফিউশন প্রযুক্তি। এটি যেন আকাশে উড়ন্ত এক সুপার কম্পিউটার। এর চারপাশে থাকা অসংখ্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেন্সর ও ক্যামেরা পাইলটকে ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখার সুবিধা দেয়। পাইলট যে বিশেষ হেলমেটটি ব্যবহার করেন তার দামই প্রায় চার লাখ ডলার। এই হেলমেটের ডিসপ্লে সিস্টেম বা এইচএমডিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে পাইলট বিমানের মেঝের মধ্য দিয়েও নিচের দৃশ্য দেখতে পান। অর্থাৎ বিমানটি পাইলটের দৃষ্টিতে স্বচ্ছ হয়ে যায়, যা আকাশযুদ্ধের সময় এক অভাবনীয় সুবিধা এনে দেয়।

এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি: সংগৃহীত
আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্যের আদান-প্রদান জয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এফ-৩৫ আকাশে থেকেই ভূমিতে থাকা বাহিনী এবং অন্যান্য বিমানের সাথে মুহূর্তের মধ্যে তথ্য শেয়ার করতে পারে। এটি শত্রুর অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করে নিজেই আক্রমণ করতে পারে অথবা পেছনের সারিকে মিসাইল ছোড়ার নির্দেশ দিতে পারে। নিজের রাডার জ্যামিং ক্ষমতার মাধ্যমে এটি শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো করে দিতেও সক্ষম। তাই একে বলা হয় আকাশের বুকে এক অদৃশ্য সেনাপতি, যা পুরো যুদ্ধক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।
যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়োজন ও ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী এই বিমানের তিনটি ভিন্ন সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে, যা প্রকৌশলবিদ্যার এক অনন্য নিদর্শন। এফ-৩৫এ হলো সাধারণ রানওয়েতে ওঠানামা করার জন্য, যা মূলত বিমানবাহিনী ব্যবহার করে। এফ-৩৫বি-এর রয়েছে হেলিকপ্টারের মতো খাড়াভাবে বা ভার্টিক্যালি ওড়ার এবং নামার ক্ষমতা। ছোট রণতরী বা দুর্গম কোনো স্থানে যেখানে বড় রানওয়ে নেই সেখানে এটি সহজেই অপারেশন চালাতে পারে। এফ-৩৫সি তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিমানবাহী রণতরী বা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে পরিচালনার জন্য, যার ডানাগুলো ভাজ করে রাখা যায়।

এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি: সংগৃহীত
এর গতি ও সমরাস্ত্র বহনের ক্ষমতাও ঈর্ষণীয়। প্র্যাট অ্যান্ড হুইটনির শক্তিশালী ইঞ্জিনের সাহায্যে এটি শব্দের চেয়েও দ্রুতগতিতে উড়তে পারে। স্টেলথ ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এটি ইন্টারনাল বে তথা নিজের পেটের ভেতর বিশাল সব লেজার গাইডেড বোমা ও মিসাইল লুকিয়ে রাখতে পারে। বাইরে অস্ত্র বহন করলে রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে যখন স্টেলথ মোডের প্রয়োজন হয় না তখন ডানার নিচেও এটি প্রচুর অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। এটি আকাশ থেকে আকাশে এবং আকাশ থেকে ভূমিতে সমান পারদর্শিতার সাথে আক্রমণ চালাতে পারে।

এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা এই বিমানটি ব্যবহার করছে। এর রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর পরিচালনা বেশ জটিল। তবুও কৌশলগত দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
