চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন: এএসপি থেকে আইজিপি, তারপর রাজসাক্ষী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৮:৪৭, ১৭ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৫৮, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ট্রাইবুন্যালে
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিন আসামীর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বাকি আসামী পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শুরু থেকেই এই মামলার আসামী ছিলেন এই সাবেক আইজিপি। ১০ জুলাই এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে কোনো আবেদন করেননি। তার বদলে তিনি দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল তার রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করে।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুর ২ টা ৫০ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন— বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
কে এই রাজসাক্ষী মামুন
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জন্মেছিলেন ১৯৬৪ সালে, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লায়। তার গ্রামীণ শুরু আর উচ্চাশার মিশেলে গড়ে উঠেছিল এক পেশাদার পুলিশ অফিসারের ইমেজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, যা তার পরবর্তীতে পুলিশের কর্মকাণ্ডে এক ধরণের বোধগম্যতা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ যোগ করেছিল।
এএসপি দিয়ে শুরু
তার পুলিশ ক্যারিয়ার একদম সাধারণ পথ দিয়ে শুরু হয়- এএসপি পদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কেল থেকে, তারপর সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর ও অন্যান্য জেলায় বিভিন্ন সার্কেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন। ধীরে ধীরে তিনি পুলিশ সদর দপ্তর, মেট্রোপলিটন পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে ওঠানামা করেছেন। তার কাজের পরিধি বিস্তৃত—শুধুমাত্র সাধারণ পুলিশিং নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থায়ও অংশগ্রহণ করেছেন; জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, যা তার পেশাদার পরিচয়ে একটি গ্লোবাল মাত্রা যোগ করেছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এ তার নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ২০২০ সাল থেকে তিনি র্যাবের-র মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সেই ক্ষমতায় একাধিক অভিযান চালান যা ‘জঙ্গিবিরোধী’ বলেই রাষ্ট্র কর্তৃক উচ্চ মূল্যায়ন পায়।
আইজিপি থেকে রাজসাক্ষী
২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, মন্ত্রনালয় কর্তৃক তাকে আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার এই পদোন্নতি ছিল বিশেষ চুক্তির ভিত্তিতে: এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। পরবর্তীতে তার আইজিপির দায়িত্ব আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়। এই সময়ে, তার সমর্থকরা বলেছিল যে তার অভিজ্ঞতা এবং পুরনো পুলিশিং দক্ষতা তাকে অত্যন্ত কার্যকর নেতায় পরিণত করেছিল।
আইজিপি হিসেবে তার সময়কে অনেকে গুণ করেছেন সফল দায়িত্ব পালনের দৃষ্টিকোণ থেকে- বিশেষ করে র্যাব মাদকবিরোধী অভিযানে, এবং `অপারেশন সুন্দরবন’ নিয়ে অভিযোগ ও পুরস্কারের মিশ্র প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল। তার নেতৃত্বে র্যাব মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, যা অনেকের কাছে তার দক্ষতা ও সংকল্পের প্রমাণ ছিল।
তবে তার উত্থান থেকে পতন দ্রুত ও নাটকীয় ছিল। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, জুলাই‑আগস্ট গণঅভ্যুত্থান (শিক্ষার্থী আন্দোলন) এবং সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় তার বিরুদ্ধে বহু হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করা হয়।
সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অংশ হলো—তিনি রাজসাক্ষী হতে সম্মত হন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দিতে, তিনি দাবি করেন যে সে শুধু নিজেই দোষ স্বীকার করেনি, বরং রাজনৈতিক নির্দেশনাও ছিল, এবং তিনি সেই সব সত্য উন্মোচন করতে চান যা `জনতার জন্য’ গুরুত্বপূর্ণ।
সে-সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তির কারণে তার আইনি অবস্থান নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। ২০২৫ সালের জুলাইতে ট্রাইব্যুনাল তার ‘রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন’ মঞ্জুর করে এবং তিনি জনগণের সামনে ক্ষমা চেয়েছেন — ‘গণহত্যা’ ও ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ এর জন্য।
