ফিলিস্তিনের নিউ ভিশনস শিল্প আন্দোলন
হাসান আল মামুন
প্রকাশ: ২১:০৫, ১৬ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২১:৩১, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
কাঠের তৈরি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
১৯৮৯ সালে ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনে দখলদারি শুরু করে তখন কয়েকজন শিল্পী সিদ্ধান্ত নেন ভিন্ন ভাষায় কথা বলার। তারা বুঝেছিলেন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে জড়ানো বেদনা ও স্বপ্নই প্রকৃত শিল্পের উপকরণ হতে পারে। অস্ত্র ছিল না, ক্ষমতা ছিল না। ছিল শুধু একটাই শক্তি, অদম্য আকাঙ্ক্ষা। সেই শক্তি থেকেই গড়ে ওঠে নিউ ভিশনস শিল্প আন্দোলন।
চার শিল্পী তখন এক হয়ে কাজ শুরু করেন। তারা আঁকেন। চামড়া, কাঠ ও পাথর দিয়ে নানা আকৃতি তৈরি করেন। মানুষের বঞ্চনাকে নিজেদের শিল্পের উপাদান বানান। তাদের কাছে চিত্রাঙ্কন ছিল প্রতিদিনের জীবনকে দেখে নেওয়ার একটি কাঁচ। সেই কাঁচে প্রতিফলিত হতো সংগ্রামের সৌন্দর্য এবং মাটির সঙ্গে মানুষের ঈমানী সম্পর্ক। তারা বিশ্বাস করতেন ভেতরের স্বাধীনতাই শিল্পীকে প্রকৃত শিল্পী করে তোলে।
সেই উত্তাল দিনগুলোয় তারা আঁকেন এমন সব দেয়ালচিত্র, যা সময়ের দলিলও বটে। আজ যখন প্রথম ইন্তিফাদার (ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের আন্দোলন) সায়ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং নিউ ভিশনস আন্দোলনের পঁয়ত্রিশ বছর, তখন সেই শিল্পীরা আবার আলোচনায় এসেছেন। তাদের মধ্যে নাবিল আনানি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা দেয়ালচিত্রগুলো তৈরি করেছিলেন, সেগুলো আজও মনে করিয়ে দেয়, চিন্তার বিপ্লব কোনো কাগজে আটকে থাকে না। তা মানুষের রক্তে, মাটিতে, পাথরে গেঁথে যায়।

নাবিল আনানি। ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল ইসরায়েল। ঘরবাড়ি, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি, রাস্তা, শিল্পীর স্টুডিও কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি তাদের থেকে। তবুও ফিলিস্তিনিরা লড়াই থামায়নি। তারা অন্ধকারে ঢুকে সেখান থেকে আলো টেনে এনেছে। যুদ্ধ যত ভয়ংকর হয়েছে, তাদের বাঁচার এবং সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা ততই বেড়েছে।
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিন মিউজিয়ামের স্থায়ী প্রদর্শনীর ভিত্তি হিসেবে অনেক দেয়ালচিত্র জায়গা পেয়েছে। পাশে লেখা নেই কোনো অতিরঞ্জিত মন্তব্য। আছে কেবল গভীর কৃতজ্ঞতা। নিউ ভিশনস গোষ্ঠীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অনেকে, তারা সৃজনশীলতার নতুন দরজা খুলেছিলেন, ইতিহাস থেকে শক্তি নিয়েছিলেন। এই যাত্রায় যুক্ত হয়েছিল বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প অনুষদের তরুণ শিক্ষার্থীরাও। তারা কাজে অংশ নিয়েছে, নিজেদের সময় দিয়েছে।
লারা সালাউজ। ছবি: সংগৃহীত
নিউ ভিশনস আন্দোলনের সদস্য লারা সালাউজ, তিনি যে নারীদের সঙ্গে কাজ করেন, তারা অনেকেই পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী। স্বামীর কাজ হারানোর পর এই নারীরাই পরিবারের ভরসা। অথচ তাদের গ্রামে পৌঁছানোই এখন বিপজ্জনক। ফলে উপকরণ পাওয়া বিলম্ব হয়, কাজ থেমে যায় বারবার।
আনানি নিজেও বছরের পর বছর ধরে একই সংকটে আছেন। ভেড়ার চামড়া সংগ্রহ করতে হেবরনে যেতে হয়। কিন্তু পথে পথেই বাধা। চেকপোস্ট, প্রশ্ন, সব মিলিয়ে শিল্পাঙ্গন যেন যুদ্ধক্ষেত্র। তার মতে, শিল্পকে রক্ষা করার চেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে শিল্পীর নিরাপত্তা।
গাজার তরুণ শিল্পী হুসেইন আল জারজাভি ক্যানভাস না পেয়ে জাতিসংঘের ত্রাণের আটার ব্যাগে আঁকা শুরু করেন। দেয়ালের রং, পেন্সিল, কলম, যা আছে তাই দিয়ে ধরে রাখেন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও মানুষের মুখ। কিন্তু অবরোধের কঠোরতায় এখন আটার ব্যাগও নেই। তবুও তিনি খালি ব্যাগ কিনে আঁকা চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেন। শিল্প যেন তার শ্বাস নেওয়ার উপায়।
আনানি বলেন, গাজায় কাজ করা মানে উপকরণের অভাবকে নিয়তি হিসেবে মেনে নেওয়া। সেখানে শিল্পীরা পুড়ে যাওয়া বস্তু, বালু বা ভেঙে যাওয়া অংশ ব্যবহার করে সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। কারণ একটাই, হাল না ছাড়া।
উপকরণ বিরল, পথ ঠাসা প্রতিবন্ধকতায়, জীবন অনিশ্চিত, তবুও সৃষ্টির আগুন নিভানো যায় না। নিউ ভিশনস ফিলিস্তিনের শিল্পীদের নীরব প্রতিপত্তি। সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকেও তারা দেখিয়েছেন কীভাবে মাটি, চামড়া, পোড়া কাঠ, এমনকি আটার ব্যাগেও ফুটে উঠতে পারে প্রতিরোধের ভাষা। তাদের কাছে শিল্প মানে শুধু রূপ নয়, সাহস। আর সেই সাহস আজও ফিলিস্তিনের মানুষকে আশ্বাস দেয়, ধ্বংসের ভেতরও জীবনের রং খুঁজে পাওয়া যায়।
যতই ধ্বংস হোক, যতই হামলা হোক, তাদের শিল্প টিকে থাকবে। তাদের মাটি টিকে থাকবে। তাদের স্মৃতি টিকে থাকবে। আর সেই দেয়ালচিত্রগুলো থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও শিখবে এক অনমনীয় অধ্যবসায়ের গল্প। সৃজনশীলতা কখনো পরাজয় মানে না।
