শেখ হাসিনাকে ফেরত
কী বলছে আইন ও দুই দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৭:৫৯, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
শেখ হাসিনা , ফাইল ছবি
তিনটি কাউন্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি অভিযোগে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শুনিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণআন্দোলন দমনে এক হাজার ৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজে’ বা দমন-পীড়ন ঠেকাতে পুলিশকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয় রাখা। রায়ের আগেই তিনি ভারতে অবস্থান করছিলেন এবং রায়ের পর থেকে তার প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভারতের কাছে আবারও আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে- ভারত কি এই অবস্থায় তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য?
ভারতের অবস্থান: আইনি পথে সিদ্ধান্ত
গত অক্টোবরেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি মন্তব্য করেন, হাসিনাকে প্রত্যর্পণ ‘সম্পূর্ণ আইনি বিষয়’, যা দুই দেশের পরামর্শ ও আলোচনার মাধ্যমে এগোবে। তিনি বলেছেন, ‘এটি বিচার বিভাগীয় ও আইনি প্রক্রিয়া। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে প্রযুক্তিগত আলোচনায় প্রস্তুত’।
গত বছরের ডিসেম্বরে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ‘ভার্বাল নোট’ পাঠিয়ে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছিল। ভারত সেই চিঠি পেয়েছে বলে জানালেও প্রত্যর্পণ বিষয়ে কোনো অবস্থান তখন জানায়নি। কারণ চিঠির ‘বৈধতা’, অর্থাৎ অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার অন্য দেশের নির্বাচিত সরকারের কাছে রাজনৈতিক নেতার প্রত্যর্পণ চাইলে তা কতোটা গ্রহণযোগ্য- সেটি যাচাই করা প্রয়োজন বলে মনে করে নয়াদিল্লি।
আইন কী বলছে
বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি (২০১৩) থাকলেও এতে কয়েকটি বড় শর্ত থাকায় ভারত বাধ্য নয়। চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, রাজনৈতিক চরিত্রের অভিযোগে প্রত্যর্পণ করা যাবে না। অর্থাৎ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ হলে প্রত্যর্পণ হবে না। যদিও হত্যা, গুম বা নির্যাতনের মামলা রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না, যদি বিচার ‘অসৎ’ না হয়।
প্রাণ সংকট থাকলে প্রত্যর্পণ নয়
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, রায় ঘোষণার পর শেখ হাসিনার প্রাণ সংকট বাড়লে ভারত তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয়।
তিনি জানান, চুক্তিতে স্পষ্ট করা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে, বিচারের উদ্দেশ্য সৎ না হলে, জীবনের ঝুঁকি থাকলে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকলেও প্রত্যর্পণ হবে না। এগুলো ভারতের জন্য শক্ত আইনি ভিত্তি তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুরক্ষা
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরিন্দম দাস বলেন, যদি কোনো দেশে প্রত্যর্পণের পর ব্যক্তির জীবনের ঝুঁকি থাকে, তাকে আশ্রয় দেওয়া দেশ ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয়। এখানেই ভারতের শক্ত আইনি অবস্থান তৈরি হয়।
সুপ্রিম কোর্টে আপিলের অধিকার
শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। কিন্তু দেশে না থাকলে এই অধিকার ব্যাহত হওয়া ‘মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন’ হতে পারে।
প্রত্যর্পণ চুক্তির মূল কাঠামো
২০১৩ সালে মনমোহন সিংহ সরকার এবং হাসিনা সরকারের সময় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মূল শর্তগুলো হলো, ন্যূনতম এক বছরের কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ হলে প্রত্যর্পণ সম্ভব। সেই অপরাধ দুই দেশেই ‘শাস্তিযোগ্য’ হতে হবে, অপরাধে প্ররোচনা বা সাহায্য করলেও প্রত্যর্পণের আওতায় পড়বে।
আইনটিতে ২০১৬ সালের সংশোধনীতে শুধু গ্রেপ্তারি পরোয়ানাই যথেষ্ট, প্রমাণ জমা দিতে হবে না। শেখ হাসিনার নামে একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় সংশোধিত চুক্তির ভিত্তিতে তাকে ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
কেন করা হয়েছিল এই চুক্তি?
২০১৩ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের পটভূমি ছিল, উত্তর–পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে উগ্রপন্থীদের আশ্রয়, জেএমবিসহ চরমপন্থী সংগঠনের বাংলাদেশ ও ভারতে উপস্থিতি রোধ এবং সীমান্তপারের অপরাধীদের হস্তান্তর নিশ্চিত করা।
ফলে, এই চুক্তি মূলত রাজনৈতিক আশ্রয় বা মানবাধিকারের মতো জটিল বিষয়ে নয়, বরং নিরাপত্তা–সম্পর্কিত অপরাধ দমনে কেন্দ্রীয় ছিল।
পরিস্থিতির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতের আশ্রয়ে যান ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেই থেকেই তার প্রত্যর্পণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক–আইনি টানাপড়েন চলছে।
