শেখ হাসিনার গড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আলোচিত যত রায়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৮:০৮, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
ছবি: ফাইলফটো
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এই দাবি পূরণের সুবাতাস বইতে শুরু করে ২০১০ সালের মার্চে, যখন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রক্রিয়াটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রথম কয়েক বছরেই এই ট্রাইব্যুনাল একের পর এক আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করে দেশ-বিদেশের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গঠিত ওই ট্রাইব্যুনাল মোট ৫৭টি মামলার রায় দেয়। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ছয়জনের, যাদের পাঁচজন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং একজন বিএনপির প্রভাবশালী রাজনীতিক। বিচারের পুরো প্রক্রিয়াটি নানা বিতর্ক, সংশোধনী ও আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। কখনো আইনটির বিভিন্ন ধারা নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে, কখনো স্কাইপ যোগাযোগকে ঘিরে বিচারপতিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও এসেছে ধারালো মতামত। সাক্ষীদের নিরাপত্তা, প্রভাব, জেরা—সবকিছু মিলিয়ে সেই সময়ে ট্রাইব্যুনাল ছিল দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিচারব্যবস্থা।
এরপর আসে গত বছরের জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণঅভ্যুত্থান। সেই পরিবর্তনের পর ক্ষমতায় আসে অন্তর্বর্তী সরকার, যারা জুলাই-আগস্টে সংঘটিত নতুন একটি মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনার বিচার করতে একই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নতুনভাবে পুনর্গঠন করে। পুনর্গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল আগের অভিজ্ঞতা, সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনাকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন কাঠামো সৃষ্টি করে, তদন্তকারী সংস্থা থেকে শুরু করে প্রসিকিউশন—প্রত্যেকে আরও সমন্বিতভাবে কাজ করে।
এই নতুন ট্রাইব্যুনালের প্রথম মামলার রায় ঘোষণা হলো আজ, ১৭ নভেম্বর, যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মামলার দিনে সকাল থেকেই আদালত চত্বরে ছিল কড়া নিরাপত্তা, বিশেষ করে যেহেতু মামলার আসামিরা দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। রাজসাক্ষী মামুনকে সকালে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে করে আদালতে আনা হয়।
দুপুর সাড়ে ১২টার কিছু পর তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এজলাসে ওঠেন। ঠিক ১২টা ৪০ মিনিটে রায়ের ৪৫৩ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত সংস্করণের পাঠ শুরু হয়। প্রথমে রায়ের সূচনা অংশ পড়েন বিচারিক প্যানেলের সদস্য মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। পরে বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ রায়ের একটি বড় অংশ পাঠ করেন। সর্বশেষ অংশটি পাঠ করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। পুরো রায় পড়তে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা দশ মিনিট।
রায়ে বলা হয়, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড, উসকানি, মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ এবং ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়টি লাশ পোড়ানোর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই ঘটনায়, অর্থাৎ চানখারপুল ও আশুলিয়া হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। রাজসাক্ষী মামুন স্বেচ্ছায় তথ্য দিয়ে আদালতকে সহযোগিতা করায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আদালত মত দিয়েছে, একই অপরাধে যুক্ত থাকলেও সত্যনিষ্ঠা ও স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তার প্রতি নমনীয়তা দেখানো হয়েছে।
মামলার বিচারপ্রক্রিয়া ছিল সময়সাপেক্ষ এবং প্রমাণ-নির্ভর। মোট ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন হয় ২৮ কার্যদিবসে। প্রায় আট হাজার সাতশোরও বেশি পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করা হয়, যার মধ্যে দালিলিক প্রমাণ, ফরেনসিক তথ্য, জব্দকৃত উপকরণ, শহীদদের তালিকা ও সাক্ষ্যসমর্থক প্রতিবেদনের একটি বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক, প্রতিযুক্তি ও চূড়ান্ত বক্তব্য উপস্থাপনের পর গত ১৩ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে রায়ে কষ্ট পেয়েছেন। কারণ ক্লায়েন্ট আত্মসমর্পণ বা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত তার পক্ষে আপিলের সুযোগ নেই। তার ভাষায়, ‘রায়টি ভিন্ন হতে পারতো, কিন্তু তা হয়নি। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে আমার কিছুই করার ছিল না।’
এই রায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় এক নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল। ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়েছিল একাত্তরের অপরাধের বিচার দিয়ে। কিন্তু আজকের রায় প্রথমবারের মতো জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সাজা প্রদান করল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই রায় ভবিষ্যতে ক্ষমতার অপব্যবহার, গণহত্যা, পরিকল্পিত সহিংসতা বা রাষ্ট্রীয় অস্ত্র ব্যবহারের মতো অভিযোগের ক্ষেত্রে আদালতের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করবে।
বাংলাদেশের আইনি ও রাজনৈতিক ইতিহাসে আজকের দিনটি তাই শুধু একটি রায় ঘোষণার দিন নয়—বরং বিচারযাত্রার একটি নতুন মোড়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।
