শেখ হাসিনা-কামালের সম্পদে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫:৩২, ১৭ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৫:৩৭, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
শেখ হাসিনা ও আসাুজ্জামান খান কামাল
জুলাই গণআন্দোলনে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। পাশাপাশি দেশে থাকা তাদের দুজনের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে গত বছরের জুলাই-আগস্টে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
অন্যদিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন রাজসাক্ষী হয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করা অন্য আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তবে তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত বা জরিমানা করেননি ট্রাইব্যুনাল।
তিনজন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে পলাতক দেখিয়ে বিচার সম্পন্ন করেছেন ট্রাইব্যুনাল। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এজলাসের আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলাগুলোর মধ্যে প্রথমটির রায় ঘোষণা করা হলো। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চারটি মামলারও প্রথমটির রায় এটি।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রায়ে জানিয়েছেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণআন্দোলন দমনে এক হাজার ৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচটি মানবতাবিরোধী অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেগুলোকে দুটি অভিযোগে পরিণত করে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনাকে সাভারের আশুলিয়া এবং ঢাকার চাঁনখারপুলে দুটি গণহত্যায় মোট ১২ জনকে হত্যায় মারণাস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দেওয়ার একটি অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড এবং হত্যায় উসকানির অন্য অপরাধটির দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। আর আসাদুজ্জামান খান কামালকে সাভার ও আশুলিয়ায় ওই ১২ জনকে গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আর চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে সব অপরাধ প্রমাণিত হলেও তিনি রাজসাক্ষ্য দেওয়ায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
ছয়ভাগে বিভক্ত মোট ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, বিশেষত প্রধান আসামি শেখ হাসিনাকে আন্দোলন চলাকালে মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধের মাস্টারমাইন্ড (পরিকল্পনাকারী), হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার (সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা) হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছেন প্রসিকিউশন। তার বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণিত প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, গণভবনে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য এবং এর প্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ মাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণের অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না দেওয়া এবং ষড়যন্ত্রের অপরাধ আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে।
প্রমাণিত দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামি শেখ হাসিনার ছাত্র-জনতার উপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ এবং এ নির্দেশ বাস্তবায়নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশের পাশাপাশি সহায়তা, সম্পৃক্ততা ও ষড়যন্ত্র করেন।
প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের ‘বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে’ তাকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচণা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘাটত হয়েছে।
প্রমাণিত চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কহত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
প্রমাণিত পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশেপাশের এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃতদেহ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে। ওই ঘটনায় হত্যা, নির্যাতন, মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে হওয়া মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালে প্রথম এই মামলাটির কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিসকেস বা বিবিধ মামলাটি হয়। একই দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। ১৬ মার্চ তার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর ১২ মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। প্রতিবেদনে আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নাম প্রথমবারের মতো আসে। ফলে আসামি হন তিনজন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরীহ, নিরস্ত্র দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ৩০ হাজার মানুষকে আহত করা হয়েছিল।
১ জুন তিনজন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন।
ফরমাল চার্জ দাখিলে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিক মামলায় রূপ নেয়। এ মামলায় গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন জানান সাবেক আইজিপি মামুন।
৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এবং ৪ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
সূচনা বক্তব্যের পর এই মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন জুলাই গণআন্দোলনে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। তার সাক্ষ্যগ্রহণে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
এ মামলায় সাক্ষ্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।
‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।
মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা চলছে। অন্য তিনটির মধ্যে ২০১৩ সালের মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের ‘হত্যা-নির্যাতনের’ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি করা হয়েছে ২১ জনকে। এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়িয়ে আগামী বছরের ১২ জানুয়ারি নির্ধারিত হয়েছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ২৮ জন। আসামিদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান ২৩ জন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। এই দুটি মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ নভেম্বর।
অন্যদিকে আদালত অবমাননার মামলায় ২ জুলাই শেখ হাসিনাকে ছয়মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’—শেখ হাসিনার এমন একটি বক্তব্যের অডিও রেকর্ড অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছিল চলতি বছরের শুরুর দিকে। তার এমন বক্তব্য বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা উল্লেখ করে আদালত অবমাননার মামলাটি করেন প্রসিকিউশন। এপ্রিল মাসে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারি করতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আবেদন জানিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। প্রসিকিউশন জানিয়েছেন, রায়ে যদি ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনারক সাজা দেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আরেকটি ‘কনভিকশন ওয়ারেন্টের’ (দণ্ডাদেশের পরোয়ানা) আবেদন জানানো হবে।
