চোখ হারানো খোকনের সাক্ষ্য থেকেই শুরু হয় হাসিনার বিচার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫:৪২, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে একটি চোখ হারানো ছোটবাস চালক খোকন চন্দ্র বর্মন (বাম থেকে তৃতীয়) ।ছবি: সংগৃহিত
বাংলাদেশের গণআন্দোলনের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়গুলোর একটির ঘটনা শুনে আদালত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর সেই ঘটনার প্রধান সাক্ষ্যদাতা ছিলেন নারায়ণগঞ্জের ছোট বাসচালক খোকন চন্দ্র বর্মন, যিনি পুলিশের গুলিতে হারিয়েছেন তার একটি চোখ। তার বেদনাদায়ক সাক্ষ্যের ওপর দাঁড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩ অগস্ট শুরু হয় বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লা আল-মামুন এর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে।
সাক্ষ্য দিতে দাঁড়িয়ে খোকন জানান—২০২৪ সালের ১৮–১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকায় ছাত্র–জনতার বিক্ষোভে তিনি সরাসরি দেখেছিলেন পুলিশের গুলিবর্ষণ। তাঁর চোখের সমান উচ্চতায় ছুটে এসেছিল একটি গুলি, যা উপড়ে দেয় একটি চোখ, বিকৃত করে দেয় নাক–মুখ। বহু অস্ত্রোপচার সত্ত্বেও আজও তার মুখে থেকে গেছে সেই দাগ।
২০২৪ সালের ৫ অগস্ট যাত্রাবাড়ী—তার চেয়েও ভয়াবহ। উড়ালসেতুর নিচে একটি ব্যারেলের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। পুলিশ তাঁকে ধরে টেনে আনে, মুখ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলি মুখে লাগে, ছিটকে গিয়ে প্রাণ বাঁচলেও চিরতরে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় জীবন।
দুঃস্বপ্নের স্মৃতি বলতে গিয়ে কেঁপে ওঠেন তিনি: ‘আমি বিচার চাই। আমি চাই শেখ হাসিনা, কামাল, মামুন, কাদের, শামিম ওসমানের সাজা হোক—আমাকে আহত করার জন্য, আমার হাজার ভাইকে খুন করার জন্য।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং শেখ হাসিনার ফোনালাপের রেকর্ড আদালতে উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
সরকারি কৌঁসুলি জানান, ফোনে হাসিনা তাপসকে স্পষ্ট নির্দেশ দেন—প্রতিবাদীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাও। এই অডিও–নথিই বিচার শুরুর অন্যতম নির্ণায়ক প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়।
সাক্ষ্য প্রদানের পর আদালতে দেখানো হয় গণআন্দোলনের সময়কার ভিডিও, নিহত–আহতদের পরিবারের বক্তব্য এবং একটি তথ্যচিত্র।সেখানে ছিল—নিহত আবু সাঈদ,মির মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ,মাহবুবুর রহমান সৈকত, নিখোঁজ সাংবাদিক তাহির জামান — তাদের পরিবারের হৃদয়বিদারক বয়ান।এই দৃশ্য দেখে আদালতে উপস্থিত অনেকেই কান্না থামাতে পারেননি।রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনও ফুঁপিয়ে ওঠেন।
হাসিনা ও কামালের পক্ষে আইনজীবী আমির হোসেন দাবি করেন—খোকনের বক্তব্য ও তদন্ত রিপোর্টে নাকি অসামঞ্জস্য আছে।
কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ পাল্টা যুক্তি দেয়—সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সাক্ষ্যের বৈধতাকে তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
খোকনের সাক্ষ্যে উঠে আসে তিনটি ভয়ানক দিন:
১৮ জুলাই ২০২৪
নারায়ণগঞ্জের ছাত্র বিক্ষোভ; পুলিশের বুলেটে সামনে একজনের মৃত্যু তিনি প্রত্যক্ষ করেন।
১৯ জুলাই ২০২৪
চাষাড়া যাওয়ার পথে আবারও গুলিবর্ষণ; বহু আহত।
৫ অগস্ট ২০২৪
সাইনবোর্ড থেকে ঢাকায় আসার পথে যাত্রাবাড়ীতে ভয়ঙ্কর হামলা—‘পশুবলির মতো রক্ত পড়ে ছিল পথে।’
সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি সামলে দিলেও চলে যেতেই পুলিশ আবার গুলি শুরু করে।
এই সব সাক্ষ্য, প্রমাণ, ভিডিও, ফোনালাপ—সব মিলিয়ে সোমবার আদালত হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
দেশজুড়ে টানটান উত্তেজনার মাঝে এই রায় ঘোষণার আগে থেকেই ঢাকাকে দুর্গে পরিণত করা হয়—মোতায়েন হয় ১৫ হাজার পুলিশ, ট্রাইব্যুনালের চারপাশে সেনা।
